
জাহাজ ভাঙা শিল্পের বাজারের মন্দাভাব
১ আগস্ট ১৫।। সাম্প্রতিক কালে শিপ রিসাইক্লিং সেক্টরের বাজারের মন্দাভাবের কারণে এই সেক্টর সংকটের সম্মুখীন হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশেষ করে আন্তর্জাতিক বাজারে স্ক্র্যাপ জাহাজের ও একই সাথে বিলেটের দাম অস্বাভাবিক হারে ক্রমান্বয়ে হ্রাস পেতে শুরু করেছে। উদাহরণস্বরূপ গত অর্থবছরে আমদানিকৃত স্ক্র্যাপ জাহাজের মূল্য গড়পরতা এক পরিসংখ্যানে দেখা যায় ৪৮০ মার্কিন ডলার (প্রতি মেঃ টন) থেকে কমে ৩৪০ মার্কিন ডলারে এবং একই সময়ে বিলেটের মুল্য ৫০০ মার্কিন ডলার থেকে কমে ৩২৫ মার্কিন ডলার (প্রতি মেঃ টন) এসে দাঁড়িয়েছে। অথচ অতীতে আমদানিকৃত স্ক্র্যাপ জাহাজের স্ক্র্যাপ, উৎপাদিত রড সহ প্রায় ১৫ লাখ টন মালামাল এখনো অবিক্রিত অবস্থায় রয়ে গেছে। এখানে উল্লেখ থাকে যে, আমাদের ক্রয়কৃত জাহাজের মজুদকৃত যে মালামাল গত ৩ মাস আগেও প্রতি মেঃ টন ৪২,০০০/- টাকায় বিক্রি করা হয়েছে, তা এখন কমে দাঁড়িয়েছে ৩০,০০০/- টাকায়। জাহাজের প্লেটের রডের দাম ছিল ৪৮,০০০/- টাকা তা এখন কমে দাঁড়িয়েছে ৩৭,০০০/- টাকায়। অথচ বিলেটের দাম যখন ৬০০/- মার্কিন ডলার ছিল তখন প্রতি মেঃটন ৫৫,০০০/- টাকায় বিক্রি হত। বর্তমানে দাম ৩২৫/-মার্কিন ডলার, তাদের রড এখন বিক্রি হচ্ছে ৫৪,০০০/- টাকায়।
তদুপরি ২০১৪ সালের শুরু থেকে বিশেষ করে ২০১৫ সালের প্রথমার্ধে দেশে সহিংসতার কারণে ব্যবসা বাণিজ্য এক প্রকার বন্ধ হয়ে যায়। এসময় টানা অন্তত ৬ মাস জাহাজ ভাঙা শিল্পে স্ক্র্যাপ লোহা, তামা–পিতলসহ সব রকম মালামাল বিক্রি সম্পূর্ণরূপে বন্ধ থাকে। কিন্তু ইয়ার্ড বন্ধ থাকলেও সচল ছিল ব্যাংক ঋণ পরিশোধের গতি। এই শিল্প খাতে ব্যাংকের ঋণের পরিমাণ ২৫০০০/- হাজার কোটি টাকারও বেশিতে উন্নীত হয়েছে। স্ক্র্যাপ জাহাজের বিপরীতে গৃহীত ব্যাংক ঋণ পরিশোধে ব্যাংকগুলির ক্রমাগত চাপের কারণে মালিকেরা ক্রয় মূল্যের চেয়ে বহু কম দামে মালামাল বিক্রি করতে বাধ্য হন। এতে কোটি কোটি টাকা লোকসানের শিকার হয়ে পুঁজি হারিয়ে বসেন বহু মালিক। ব্যাংকিং জটিলতা ও ব্যাংকের চড়া সুদের কারণে এলসি খোলা হ্রাস পেয়েছে। ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে জাহাজ আনার পর জাহাজের মালামাল বিক্রি করেই ব্যাংক ঋণ পরিশোধ করেন উদ্যোক্তারা। কখনো মালামাল বিক্রি বন্ধ থাকলে ঋণ পরিশোধে সমস্যা সৃষ্টি হয়। কিন্তু ব্যাংকে নিয়মিত কিস্তি পরিশোধ করতে হয়েছে। পরবর্তী সময়েও অচলাবস্থা বিরাজ করতে থাকায় প্রয়োজনীয় অর্থ সংগ্রহ করতে গিয়ে প্রত্যেক মালিক কোটি কোটি টাকা লোকসানের শিকার হয়েছেন। লোকসান বেড়ে যাওয়াই অনেকে জাহাজ আমদানিই বন্ধ করে দেন।
মূলতঃ উপরোক্ত দুরবস্থার কারণে পূর্বের ১২৫টি ইয়ার্ড থেকে কমে এখন প্রায় ৩৫–৪০ ইয়ার্ড সক্রিয় রয়েছে। পাশাপাশি দেশের সবকটি রি–রোলিং মিলসহ সংশ্লিষ্ট শিল্পসমূহের উৎপাদন, পণ্য পরিবহন ও ব্যবসা–বাণিজ্যও ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এর সাথে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ৫ লাখ শ্রমিক কর্মচারীদের কর্মসংস্থান হুমকীর সম্মুখীন হয়ে দাঁড়িয়েছে।
উপরন্তু বাংলাদেশ ব্যাংকের এফই সার্কুলার নং–৩১,তারিখঃ ২৪/১০/২০১৪ইং জারীর মাধ্যমে ডেফার্ট পেমেন্টে এলসির ক্ষেত্রে ত্রৈমাসিক ভিত্তিতে কিস্তি পরিশোধের বাধ্যবাধকতা করা হয়েছে। এটা ব্যবসায়ীদের জন্য মরার উপর খাঁড়ার ঘা হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ যেখানে একবছরে কিস্তি পরিশোধে কথা রয়েছে সেখানে ত্রৈমাসিক ভিত্তিতে পরিশোধ করতে হচ্ছে। আমরা মনে করি এই সার্কুলার সাংঘর্ষিক। এই সেক্টরের ব্যবসায়ীরা এই সার্কুলার রহিত করার জন্য অর্থমন্ত্রীর সমীপে আবেদন জানিয়েছে।
তৈরী পোশাক শিল্প, হিমায়িত খাদ্য, ইত্যাদি খাতে সরকার যথেষ্ট সাবসিডি দিচ্ছেন। এমনকি নারী শিল্প উদ্যোক্তাদের জন্য শিল্প মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন এসএমই ফাউন্ডেশন থেকে রেয়াতি হারে অর্থায়ন করা হচ্ছে। কিন্তু শিপ রিসাইক্লিং সেক্টর রপ্তানীর সাথে জড়িত থাকা সত্ত্বেও এই পর্যন্ত কোন ধরনের সুযোগ সুবিধা বা প্রণোদনা দেয়া হয়নি। সুতরাং শিপ রিসাইক্লিং সেক্টরকে রক্ষার জন্য ”একটি বিশেষ ফান্ড গঠন” এর প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে।
সুতরাং, দেশের ইস্পাত শিল্পের সিংহভাগ কাঁচামাল সরবরাহকারী, অবকাঠামো নির্মাণ সহ বহুমুখী শিল্প ও বাণিজ্যের এই শিল্প খাত শিপ ব্রেকিং সেক্টরকে স্মরণাতীতকালের মহাসংকট থেকে রক্ষা করার লক্ষ্যে শিপ ইয়ার্ড মালিকদের আর্থিক ক্ষতি থেকে কাটিয়ে উঠার জন্য সুদবিহীনভাবে প্রিন্সিপ্যাল এমাউন্ট পাঁচ বছরের জন্য ব্লক (যা পরবর্তীতে কিস্তিতে পরিশোধ করা হবে) অথবা বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলার অনুযায়ী ৫০০ কোটি টাকা পর্যন্ত ঋণ রি–স্ট্রাকচারিং করা হচ্ছে। যদিওবা আমাদের সেক্টরে ঋণ কম, তবুও উক্ত সার্কুলার অনুযায়ী আমাদের ঋণও অনুরূপভাবে রি–স্ট্রাকচারিং করা যেতে পারে। তাছাড়া নতুন করে ঋণ দানের ব্যবস্থা, ও সুদ মওকুফ, উপরোক্ত এফই সার্কুলার প্রত্যাহার, উপরে সুপারিশকৃত একটি ”বিশেষ ফান্ড গঠন” এর জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক–কে নির্দেশ দেওয়ার লক্ষ্যে এই সেক্টরের ব্যবসায়ীরা অর্থমন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, গভর্নর,বাংলাদেশ ব্যাংক এর নিকট আবেদন জানিয়েছেন। বিষয়টি তারা এফবিসিসিআই ও চিটাগাং চেম্বারকে অবহিত করেছেন।
সূত্রঃ দৈনিক আজাদী