
চলছে ফিটনেসবিহীন লঞ্চ মেরামত : ডকইয়ার্ডগুলোতে তদারকি নেই কর্তৃপক্ষের
৭ জুলাই ১৫।। ঈদকে সামনে রেখে রাজধানীর উপকণ্ঠ কেরানীগঞ্জ, হাসনাবাদ, নারায়ণগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন ডকইয়ার্ডগুলোতে এখন রাজ্যের ব্যস্ততা। জরাজীর্ণ লঞ্চগুলোকে সারিয়ে তোলা হচ্ছে জোড়াতালি দিয়ে। আর নানা রঙে সাজিয়ে লঞ্চগুলোকে আকর্ষণীয়ভাবে প্রস্তুত করা হচ্ছে ঈদে ঘরমুখো মানুষের যাত্রা নিশ্চিত করতে। কিন্তু এরই ফাঁকে ফিটনেসবিহীন অনেক লঞ্চও নৌপথে নামার প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে বলে খবর রয়েছে। অভিযোগ রয়েছে- ফিটনেসবিহীন ওইসব লঞ্চ মেরামতে সরকারিভাবে কোনো তদারকি নেই। উল্টো অভিযোগ রয়েছে- সংশ্লিষ্ট প্রশাসনকে টাকা দিলেই ফিটনেসবিহীন লঞ্চ চলাচলের অনুমতি মেলে। ফলে ভরা বর্ষায় এবারের ঈদযাত্রা কতটুকু নিরাপদ হবে- এ নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।
দেশে সাম্প্রতিক বড় ধরনের দুর্ঘটনার অধিকাংশই ঘটেছে নৌপথে। এছাড়া প্রতিবছরই ফিটনেসবিহীন লঞ্চ ও অতিরিক্ত যাত্রীবহনসহ নানা কারণে ঝুঁকিপূর্ণভাবে নদী পাড়ি দিতে হয় দক্ষিণাঞ্চলসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় নৌপথের যাত্রীদের। এবারের ঈদেও একই আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। ঈদে ঘরমুখো মানুষের অতিরিক্ত চাপ সামলাতে সদরঘাটের বুড়িগঙ্গা তীরবর্তী কেরানীগঞ্জ এলাকায় মেরামত করা হচ্ছে পুরনো ফিটনেসবিহীন লঞ্চ।
কেরানীগঞ্জের তেলঘাট থেকে মীরেরবাগ পর্যন্ত প্রায় প্রতিটি ডকইয়ার্ডেই বিভিন্ন নৌযান তৈরি ও মেরামতের কাজ চলছে। অধিকাংশ ডকইয়ার্ডেই পুরনো লঞ্চ রঙ ও মেরামতের কাজ চলছে। সুন্দরবন-৭, রণদূত প্লাস, এমভি টিপু-৬, পারাবাত-৯, সৈকত-১৪, অভিযান-৫, আওলাদ-৪সহ বেশ কয়েকটি লঞ্চের মেরামত কাজ চলছে এসব এলাকার বিভিন্ন ডকইয়ার্ডে। কয়েকটি ডকইয়ার্ডের মালিক ও কর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তেলঘাট থেকে মীরেরবাগ এলাকা পর্যন্ত প্রায় ৩২টি ডকইয়ার্ড রয়েছে। এক ডকইয়ার্ড মালিক জানান, ঈদ এলেই লঞ্চ মেরামত ও রঙ করার চাপ বাড়ে। অনেকে কয়েক বছর ধরে পড়ে থাকা লঞ্চও নিয়ে আসেন।
তিনি আরো জানান, সংশ্লিষ্ট প্রশাসনকে টাকা দিলে ৩০ বছর আগের ফিটনেসবিহীন লঞ্চও চলাচলের অনুমতি মিলে যায়। যাত্রীদের নিরাপত্তা দিতে হলে উচ্চপর্যায় থেকে ফিটনেসবিহীন লঞ্চগুলো নিয়ন্ত্রণ করতে হবে বলে জানান তিনি।
কেরানীগঞ্জের আলী কদম ডকইয়ার্ডের ওয়েল্ডার সালাহউদ্দিন মিয়া জানান, সমস্ত বছর লঞ্চগুলো যাত্রী পরিবহন করে। বড়ো ধরনের আঘাত বা দুর্ঘটনা না ঘটলে সাধারণত মালিকরা সহজে তা মেরামত করতে চান না। কিন্তু ঈদুল ফিতরকে সামনে রেখে শুধু লঞ্চগুলো মেরামতের কাজই চলে না, সেই সঙ্গে সেগুলোকে ঝকঝকে করে সাজিয়েও তোলা হয়। তবে ঈদে যাত্রী আকর্ষণ করতেই যে এমনটি করা হয়- তা নয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, আসলে অনেকটা ঈদে নতুন জামাকাপড় নেয়ার মতোই একটা উৎসব ভাবনা থেকেই মালিকরা তা করেন। তিনি বলেন, ঈদে যাত্রীদের যে পরিমাণ চাপ থাকে, তাতে ভালো ও খারাপ লঞ্চ দেখার সুযোগই পান না যাত্রীরা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, পুরনো লঞ্চ মেরামতের বা পরিবর্তনের সময় সরকারিভাবে কোনো তদারকি না থাকায় মালিক পক্ষ তাদের ইচ্ছে অনুযায়ী কাজ করিয়ে নিচ্ছেন। এতে অনেক লঞ্চ ভারসাম্যহীন ও ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়ে। এছাড়া ঈদে বাড়তি আয়ের লোভে একশ্রেণির মালিক প্রত্যন্ত অঞ্চলে চলাচলকারী ফিটনেসবিহীন লঞ্চগুলোকেও ঢাকা ও মাওয়া বন্দর এলাকায় নিয়ে আসেন দক্ষিণাঞ্চলের বিভিন্ন রুটে চালানোর জন্য। ঈদের সপ্তাহখানেক আগে থেকে নৌপথে নামানো হবে এসব ঝুঁকিপূর্ণ লঞ্চ।
এদিকে, ঈদকে সামনে রেখে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ), বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্পোরেশন (বিআইডব্লিউটিসি) ও সমুদ্র পরিবহন অধিদপ্তর নৌপথে যাতায়াতে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে। লঞ্চে যাত্রী ওঠানামা, পরিবহন এবং সার্বিক নিরাপত্তাসহ কোনোরকম দুর্ঘটনা যাতে না ঘটে সে জন্য সরকার কঠোর নির্দেশনাও দিয়েছে। এ বিষয়ে সমুদ্র পরিবহন অধিদপ্তরের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা বলেন, ফিটনেসবিহীন লঞ্চগুলো মেরামতের কাজ চলছে, এমনটি আমরাও বিভিন্ন গণমাধ্যমের সংবাদে দেখেছি। কিন্তু সেগুলো নৌপথে যাতে না নামতে পারে সে বিষয়ে আমাদের ভ্রাম্যমাণ আদালত এ বিষয়ে সজাগ থাকবে। সার্বক্ষণিক কোস্টগার্ড, নৌপুলিশ, ভ্রাম্যমাণ আদালত চারটি স্পিডবোট দিয়ে নৌরুটের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হবে। এতে ফিটনেসবিহীন লঞ্চ চালানোর কোনো সুযোগ নেই। এছাড়া বিআইডব্লিউটিএও এদের শনাক্ত করতে সহায়তা করবে। তাই এ নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার কোনো কারণ নেই।
বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) এর যুগ্ম পরিচালক জয়নাল আবেদিন বলেন, আমরা ঈদের সময় বাড়তি নজরদারি করি- যাতে কোনো ফিটনেসবিহীন লঞ্চ চলাচল না করতে পারে। এ বছরও সিসি টিভির মাধ্যমে তা তদারকি করা হবে। তবুও অনেক সময় অনেক লঞ্চের ভিড়ে ফাঁকফোকর দিয়ে এসব লঞ্চ যাত্রী নিয়ে চলে যায়। ধরা পড়লে জরিমানা এবং কারাদণ্ড দেয়া হয়।
প্রসঙ্গত; সমুদ্র পরিবহন অধিদপ্তরের দেয়া তথ্যমতে দেশে প্রতিদিন এক হাজারের বেশি ঝুঁকিপূর্ণ ও ফিটনেসবিহীন লঞ্চ চলাচল করছে। বর্তমানে সারা দেশে নিবন্ধিত নৌযানের সংখ্যা প্রায় ১০ হাজার। এর মধ্যে চলতি বছর মাত্র ৫ হাজার নৌযানের বার্ষিক জরিপ সম্পন্ন হয়েছে। গত ১৩ বছরে নৌদুর্ঘটনায় মারা গেছে ৬ হাজার মানুষ। নৌদুর্ঘটনারোধে গত ৩৩ বছরে পাঁচ শতাধিক তদন্ত কমিটি গঠন করা হলেও একটিও আলোর মুখ দেখেনি।
সূত্রঃ ভোরের কাগজ