
রাঙ্গুনিয়ার পাহাড়ি বাঁশে বাঁচে ৩০ হাজার মানুষ
২২ জুন ১৫।। সোফা, দোলনা, মোড়া, চেয়ার, র্যাক, বাঁশের ঝুড়ি, কুলা, খাড়াং, চালুন, তলুইসহ মানুষের নিত্য ব্যবহার্য এসব জিনিষপত্র তৈরী হয় বাঁশ থেকে। এমন কি ঘরবাড়ি ও দালানকোটা নির্মাণেও বাঁশের জুড়ি নেই। শিক্ষার প্রধান উপকরণ কাগজ তৈরী হয় এই বাঁশ থেকে। আর এই বাঁশ প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যায় রাঙ্গুনিয়ার পাহাড়ি এলাকায়। পাহাড়ের এই বাঁশ রাঙ্গুনিয়ার অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলেছে দীর্ঘ সময় ধরে। এই বাঁশ দিয়ে নানা উপকরণ তৈরী করে জীবিকা নির্বাহ করছে রাঙ্গুনিয়ার প্রায় ৩০ হাজার মানুষ। বাঁশের উপকরণ ব্যবহারে উদ্বুদ্ধকরণ কর্মসূচি গ্রহণ ও সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলে রাঙ্গুনিয়ার অর্থনীতিতে বিপ্লব ঘটাতে পারে এই পাহাড়ি বাঁশ।
রাঙ্গুনিয়ার বাঁশ ব্যবসায়ীরা জানান, রাঙ্গুনিয়ার পাহাড়ি এলাকায় প্রচুর পরিমাণে বাঁশ জন্মে। বিশেষ করে চট্টগ্রাম উত্তর বন বিভাগের ইছামতি রেঞ্জের ইছামতি বনবিটের কাউখালী, ঠাণ্ডাছড়ি, বগাবিল ও রাজানগরের পাহাড়ি এলাকা, দক্ষিণ বন বিভাগের রাঙ্গুনিয়া ও খুরুশিয়া রেঞ্জের পদুয়া, খুরুশিয়া, দুধ পুকুরিয়া, কমলাছড়ি, দশ মাইল, নারিশ্চা, পোমরা ও কোদালা বনবিটের পাহাড়ি এলাকা থেকে প্রতি বছর প্রচুর পরিমাণে বাঁশ উৎপাদিত হয়। ভৌগোলিক অবস্থান, উপযোগী জলবায়ু ও আবহাওয়ার কারণে রাঙ্গুনিয়ার পাহাড়ি এলাকায় প্রাকৃতিক নিয়মে বিভিন্ন প্রজাতির বাঁশ উৎপন্ন হয়। উৎপাদিত বাঁশগুলোর মধ্যে বাইজ্জা, মিতিংগা, কালিছড়ি, বড়াক, শীল বড়াক ও মুলিবাঁশ উল্লেখযোগ্য। অনাদরে বেড়ে উঠা এসব বাঁশ বড় হলে নির্বিচারে কেটে বিক্রি করা হয় রাঙ্গুনিয়ার প্রধান হাট–বাজার রাণীর হাট, উদালবুনিয়া বাজার, রোয়াজার হাট, চন্দ্রঘোনা ফেরিঘাট, পদুয়া রাজার হাট, ধামাইর হাট, শান্তির হাট, গোচরা বাজার, মোগলের হাট, ক্ষেত্র বাজারসহ সবকয়টি বাজারে।
স্থানীয়রা জানান, রাঙ্গুনিয়ার বিভিন্ন বাজারে প্রতিটি বাইজ্জা বাঁশের দাম ২০০ থেকে ৩০০ টাকা। যা দেশের অন্যান্য স্থানে ৪০০ থেকে ৫৫০ টাকায় বিক্রি হয়। বিভিন্ন ধরনের মুলি বাঁশ ৮০ থেকে ১০০ টাকায় বিক্রি হয়। যা দেশের অন্যান্য স্থানে ১০০ থেকে ১৫০ টাকায় বিক্রি হয়। কালিছড়ি প্রতিটি বাঁশ ৫০ থেকে ৭৫ টাকায় বিক্রি হয়। যা দেশের অন্যান্য স্থানে ৮০ থেকে ১২০ টাকায় বিক্রি হয়। স্থানীয় পাহাড়ি আদিবাসী ও বাঙালিরা পাহাড় থেকে এসব বাঁশ কেটে বর্ষা মৌসুমে নদীপথে নিকটস্থ বাজারে নিয়ে আসে। আর শুষ্ক মৌসুমে সড়ক পথে বাজারে নিয়ে আসা হয়। একজন বাঁশ আহরণকারী প্রতিদিন কমপক্ষে ২০০ থেকে ৩০০ বাঁশ আহরণ করে বাজারে বিক্রি করে থাকে।
রাঙ্গুনিয়া পরিসংখ্যান কার্যালয় সূত্র জানায়, বাঁশ বেতের এসব কাজের জন্য রাঙ্গুনিয়ার বেশ কয়েকটি স্থানে ‘লাই পাড়া’ নামে একাধিক পল্লী গড়ে উঠেছে। রাঙ্গুনিয়ার পোমরা এলাকার ফকিরখীল লাই পাড়া এদের অন্যতম।
পোমরা লাই পাড়ার বাসিন্দা আবদুল মালেক জানান, বাঁশ বেতের তৈরী এক সেট সোফার দাম ৮ থেকে ১০ হাজার টাকা। একটি দোলনার দাম ৪০০ থেকে ১০০০ টাকা। একটি মোড়ার দাম ২০০ থেকে ৩৫০ টাকা। একটি চেয়ারের দাম ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা। একটি র্যাকের দাম ৮০০ থেকে ১০০০ টাকা। একটি কুলার দাম ৬০ থেকে ৮০ টাকা। একটি খারাং–এর দাম ৫০ থেকে ৮০ টাকা এবং একটি তলুই ১৫০ থেকে ২৫০ টাকায় বিক্রি হয় বলে তিনি জানান।
এছাড়াও বাঁশ দিয়ে তৈরী করা হচ্ছে বিভিন্ন প্রকারের বেড়া। যা বাঁশের বাড়ি তৈরী ছাড়াও টিনের চালে টিনের নিচে প্রচুর পরিমাণে ব্যবহার করা হচ্ছে। এ কাজে এখন রাঙ্গুনিয়ার পাঁচ হাজার লোক কাজ করছে। গোডাউন ভবানী এলাকার বাঁশ ব্যবসায়ী আলী আহমদ জানান, দালান কোটা করার সামর্থ্য যাদের নেই তারা এই বাঁশ দিয়ে ঘরের বেড়া ও চাল নির্মাণ করে মাথা গোজার ঠাঁই করে নেয়। দালানকোটা নির্মাণেও এই বাঁশের জুড়ি নেই। পাকা ঘরের সেন্টারিং–এর কাজে ব্যাপকভাবে ব্যবহার হয় এই বাঁশ। এছাড়া শিক্ষার প্রধান উপকরণ কাগজও তৈরী হয় এই বাঁশ থেকে।
রাঙ্গুনিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সাইফুল ইসলাম মজুমদার জানান, পাহাড়বেষ্টিত রাঙ্গুনিয়া উপজেলার দুই তৃতীয়াংশ পাহাড়ি জমিতে বাঁশ উৎপাদিত হয়। এ বাঁশ কর্ণফুলী কাগজ কলের চাহিদা মেটানোর পর দেশের বিভিন্ন স্থানে রপ্তানীও হয়। রাঙ্গুনিয়ায় উৎপাদিত বাঁশ দেশের বৃহত্তর স্বার্থ রক্ষার পাশাপাশি এ উপজেলার প্রায় ৩০ হাজার মানুষের রুটি–রুজির ব্যবস্থা করে।
তারা বাঁশ থেকে নিত্য ব্যবহার্য জিনিষপত্র বানিয়ে পরিবার পরিজনের বেঁচে থাকার বন্দোবস্ত করে। তাই বলা যায়, রাঙ্গুনিয়ার বাঁশ প্রকৃতির এক অপার দান। তিনি বলেন, রাঙ্গুনিয়ায় বাঁশের উপর ভিত্তি করে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে নানা উপকরণ তৈরীর শিল্প কারখানা স্থাপন সম্ভব। এতে কর্মসংস্থান হবে হাজার হাজার বেকার যুবকের। তিনি প্রকৃতির এ দানের প্রতি যত্নশীল হয়ে বাণিজ্যিকভাবে বাঁশচাষের উদ্যোগ গ্রহণের জন্যে বন বিভাগের প্রতি আহ্বান জানান। সূত্রঃ দৈনিক আজাদী