
বাংলায় ধান আবিস্কার
ফরহাদ মজহার কবি ও গবেষক
হরি ধান নিয়ে এক সময় গত শতাব্দির নব্বই দশকের শেষের দিকে বেশ প্রচার হয়েছিল। এমন ভাবে প্রচার হয়েছিল যাতে প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল যে এই প্রথম বুঝি বাংলাদেশের কৃষক নতুন ধানের জাত আবিষ্কার করল! সেটা ঠিক না। বাংলাদেশের কৃষকরা – অর্থাৎ আমাদের পূর্বপুরুষরা কাপালিকের মতোই হাজার হাজার ধানের জাত আবিষ্কার করেছিল। অন্তত কম পক্ষে তাদের সংখ্যা ১৫ হাজারের কম হবে না। এদের মধ্যে উচ্চ ফলনশীল, খরা সহিষ্ণু, লবন সহিষ্ণু, মুড়ির ধান, খইয়ের ধান, অসুস্থ ব্যক্তির পথ্যের জন্য ধান, সুগন্ধি ধান ইত্যাদি নানান প্রয়োজন ও চাহিদার ধান রয়েছে। কৃষক এখনও আবিষ্কার করে। কাপালিকের মতো অন্যেরা চোখে পড়ে নি, তাই খবর হয়য় নি।
আবিষ্কারের জন্য কৃষকের কোন গবেষণাগার বা ল্যাবরিটরি লাগে না। কারণ কৃষক পরিবার মানেই একেকেটা ক্ষুদে গবেষণাগার। কৃষক দৈনন্দিন সেখানে নিত্য নতুন অভিজ্ঞতার সম্মুখিন, হচ্ছে, সমাধান করছে। আবিষ্কারও করছে। নতুন জাত কৃষক আবিষ্কার করে নির্বাচনের মাধ্যমে। জমিতে নতুন কোন জাত নজরে এলে সেটা কৃষক চিহ্নিত করে, সেখান থেকে নতুন জাত বের করে। নতুন জাত কৃষকের পছন্দ হলে সেটা কৃষি ব্যবস্থায় টিকে যায়।
ঝিনাইদহ সদর উপজেলার আসানসোল গ্রামের কৃষক হরিপদ কাপালীর ক্ষেত্রেও তাঁর ব্যতিক্রম ঘটে নি। ১৯৯৯ সালে নিজের ধানের জমিতে একটি ছড়া তার নজরে পড়ে। ধানের গোছা বেশ পুষ্ট এবং গাছের সংখ্যা তুলনামূলকভাবে বেশি। ধানের বাইল (ছড়া) বের হলে তিনি দেখেন বাইলগুলো তুলনামূলকভাবে অন্য ধানের চেয়ে দীর্ঘ,এবং প্রতিটি বাইলে ধানের সংখ্যাও বেশি। ধান পাকলে তিনি আলাদা করে বীজ ধান হিসেবে রেখে দিলেন। পরের মৌসুমে এগুলো আলাদা করে আবাদ করলেন এবং আশাতীত ফলন পেলেন। এভাবে তিনি ধানের আবাদ বাড়িয়ে চললেন। তাঁর আগে বাংলাদেশের কৃষকরা যেভাবে নতুন জাত আবিষ্কার করেছে তিনিইও সেই একই নির্বান ও বাচাইওয়ের মাধ্যমে উদ্ভাবন করলেন ধানের নতুন একটি জাত। কৃষক যে এভাবেই হাজার বছর ধরে নতুন জাত আবিষ্কার করে আসছে এ সম্পর্কে শিক্ষিত সমাজের অজ্ঞতার মাত্রা সেই সময় সংবাদপত্রে ‘হরি ধান’ নিয়ে অতি উৎসাহ দেখে বোঝা গিয়েছিল। সন্দেহ নাই, হরিপদ কাপালিক একজন ভাল কৃষক। ভাগ্য ভালো এই রকম কৃষক ছিলেন বলেই তিনি ‘কৃষক’ বলতে কি বোঝায় তাঁর একটা প্রত্মতাত্ত্বিক নজির হয়য়ে উঠতে পেরেছিলেন। আবিষ্কারই যথেষ্ট নয়। পরিবেশ, প্রকৃতি ও প্রাণ ব্যবস্থায় একটি জাত টিকে যাওয়া বিশাল ঘটনা। যে দেশের কৃষক ১৫ হাজার জাতের ধান আবিষ্কার করতে পেরেছে, তাদের বৈজ্ঞানিক প্রতিভা বিস্ময়কর। সেই প্রতিভার কি হোল? তথাকথিত উন্ননের নামে আমরা তাদের হত্যা করেছি। কৃষি ব্যবস্থা এখন তাদের লাশের ওপর খাড়া আছে।
শুধু হরি ধান নয় সবগুলো স্থানীয় ধানের জাতই তথাকথিত উচ্চ ফলনশীল জাত জবরদস্তি প্রবর্তনের সরকারের নীতি ও ভূমিকার কারণে প্রায় লুপ্ত হবার পথে। এই কাজ মূলত করা হয়েছে হাজার বছর ধরে গড়ে ওঠা স্থানীয় কৃষি ব্যবস্থাকে সচেতন ভাবে ধ্বংস করার মধ্য দিয়ে। এই ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ডের দুটো দিক গুরুত্বপূর্ণ। এক. বিষ, রাসায়নিক সার ব্যবহার এবং মাটির তলা থেকে জ্বালানি বা ইলেক্ট্রিসিটি খরচ করে শ্যালো বা ডিপ টিউবওয়েল দিয়ে পানি তুলে পরিবেশের ক্ষতি করা, বৈচিত্রপূর্ণ চাষাবাদের পরিবর্তে একাট্টা একধরণের চাষাবাদ প্রবর্তন, ইত্যাদি। দ্বিতীয় দিক হচ্ছে স্থানীয় বীজ ব্যবস্থা ধ্বংস এবং বীজ আবিষ্কারের ক্ষেত্রে কৃষকের ঐতিহ্যগত চর্চা নষ্ট করে দিয়ে বীজ ডাকাতি (Biopiracy) প্রশস্ত করে দেওয়ার মাধ্যমে। এমন ব্যবস্থা করা হয়েছে যেন আমাদের বীজ অন্য দেশ বা বিদেশী কোম্পানি সহজে চুরি করে নিয়ে যেতে পারে। সর্বোপরি বাংলাদেশের কৃষকের বীজ ব্যবস্থা ও কৃষির ওপর ধনিদেশগুলোর আধিপত্য ও দখল যেন পাকাপোক্ত হয় তার জন্য বিভিন্ন আইন ও নীতি সজ্ঞানেই গ্রহণ করা হয়েছে। যেমন বাংলাদেশের বীজ নীতি, বীজ রেজিস্ট্রিকরণ পদ্ধতি ও বিধি বিধান, ইত্যাদি।
কৃষি ও কৃষক বিধ্বংসী আগ্রাসি নীতির পক্ষে যুক্তি দেয়া হয় যে আমাদের লোকসংখ্যা বেশী, অতএব খাদ্য উৎপাদনের ‘পরিমাণ’ বাড়াতে হবে। ফলে স্বাস্থ্য, পুষ্টি ও খাদ্যগুণ ইত্যাদি পরিকল্পত ভাবেই উপেক্ষা করা হয়েছে। ‘উচ্চ ফলনশীল’ কথাটা খাদ্যের গুণকে উপেক্ষা করে পরিমানকে অগ্রাধিকার দেওয়ার অদূরদর্শী চিন্তা, কিন্তু এর পেছনে রয়েছে স্থানীয় জাত ও স্থানীয় কৃষি ব্যবস্থাকে ধ্বংস করবার নীতি। পরিমাঙ্গত উৎপাদন চিন্তার অদূরদর্শিতা এখ স্পষ্ট হচ্ছে। স্বাস্থ্য ও পুষ্টি এখন বাংলাদেশের গুরুতর সমস্যা হিশাবে দেখা দিয়েছে। বাংলাদেশের স্বাস্থ্য সমস্যার শতকরা ৬৭ ভাগই এখন খাদ্য ও পুষ্টিজনিত অসুখ, যা NCD বা Noncommunicable Disease নামে পরিচিত। ডায়বিটিস আর ক্যান্সারের প্রধান কারণ খাদ্য ব্যবস্থা যা আধুনিক কৃষি ব্যবস্থার সঙ্গে সম্পৃক্ত।
কৃষি এবং কৃষি নীতির ইতিহাস সম্পর্কে ঘোর অজ্ঞতার কারনে আধুনিক শিক্ষত মধ্যবিত্ত শ্রেণীর কাছে হরিপদ কাপালিক একটি প্রত্নতাত্ত্বিক ফিগার হিশাবে গত শতাব্দির শেষে হাজির হয়েছিল। আধুনিক উন্নয়ন নীতির মূল কথাই হচ্ছে কৃষি ধ্বংস করে তাকে ইন্ড্রাস্ট্রিয়াল ফুড প্রডাকশানে রূপান্তরিত করা, গ্রাম ধ্বংস করে শহর গড়ে তোলা, যেন কৃষি ব্যবস্থা কৃষকের হাত থেকে কেড়ে নিয়ে দেশীয় ও বহুজাতিক কোম্পানির হাতে তুলে দেওয়া যায়। ক্ষমতা ও সকল প্রকার জাতীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণ রাজধানীতে কেন্দ্রীভুত করবার ফলে কৃষক রাজনৈতিক ভাবে বিলুপ্ত প্রজাতির পর্যায়ে চলে যায়। এই চলে যাবার ক্ষেত্রে রাষ্ট্র এবং কৃষি সংক্রান্ত রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। কৃষি সম্পর্কে শহরবাসী এবং শিক্ষিত মহলে ধারণা প্রায় নাই বললেই চলে। তারা ইন্ড্রাস্ট্রিয়াল ফুড প্রডাকশান আর কৃষিকে একাকার করে ভাবে – তারা জানে না যে বাংলাদেশের কৃষকরা হরিপদ কাপালিকের মতোই কমপক্ষে ১৫,০০০ হাজার ধান ‘আবিষ্কার’ করেছে। কৃষির ইতিহাসে হরিপদ নতুন কিছু নয়। কিন্তু হরিপদের তাৎপর্য হোল বিলুপ্তপ্রায় প্রাণী হিশাবে তিনি আমাদের গণমাধ্যমের বিষয় ও সংবাদে পরিণত হতে পেরেছিলেন। গণমাধ্যমের আগ্রহ ও উৎসাহ এই ক্ষেত্রে রীতিমতো উপভোগ্য বিষয় ছিল।
সম্প্রতি প্রত্নতাত্ত্বিক ফিগার কৃষক হরিপদ কাপালিক আবার সংবাদ হয়েছেন (কমেন্ট বক্সে লিঙ্ক দেখুন)। এবার আক্ষেপ! তাঁর হরিধান জেলা পর্যায়ের নানা পুরস্কার পেলেও বীজের জাত হিসেবে ‘সরকারি স্বীকৃতি’ পায় নি। বাংলাদেশের ১৫ হাজার স্থানীয় জাত কৃষক আবিষ্কার করেছিল কি ‘সরকারি স্বীকৃতি’র জন্য? কৃষক তাঁর নিজের গরজেই তাঁর জমি ও স্থানীয় প্রাণ ব্যবস্থার চরিত্র অনুযায়ী নতুন জাত উদ্ভাবন করে – ইতিহাস তাই বলে। কৃষি ধ্বংস করে আধুনিক ইন্ড্রাস্ট্রিয়াল ফুড প্রডাকশান প্রবর্তন এবং কৃষিকে পুঁজির অধীন করা হলে স্থানীয় জাত শুধু লুপ্ত হয় না, একই সঙ্গে লোকায়ত চর্চার মধ্য দিয়ে নতুন জাত আবিষ্কারেও মারাত্মক ধস নামে। এটা আন্তর্জাতিক ভাবেই স্বীকৃত বলে রাষ্ট্রসমূহকে প্রাণবৈচিত্র চুক্তি (Convention on Biological Diversity 1992) করতে হয়েছিল। এখন বলা হচ্ছে, ‘আবাদ সম্প্রসারণ না হওয়ার কারণেই হরি ধান এখন এক প্রকার বিলীনের পথে’। আসলে সরকারী স্বীকৃতি বা বাংলাদেশের তথাকথিত বীজ আইন, বীজ নীতি ও বীজ রেজিস্ট্রিকরণ আইনেই স্থানীয় জাতের আবাদ সম্প্রসারণ না হওয়ার মূল কারন। বীজ আইন ও বীজের বিধিবিধানই করা হয়েছে যেন স্থানীয় জাতের সম্প্রাসারণ না হয়, পুরা বীজ আইন ও বীজের বিধি বিধান কৃষকের বিরুদ্ধে – কোম্পানির পক্ষে। এর ফল ভোক্তাদেরও ভুগতে হচ্ছে। এই সকল আইন ও বিধিবিধানে্র মধ্য দিয়েই বিষাক্ত খাদ্য উৎপাদনের ব্যবস্থা করে রাখা হয়েছে। বীজ আইন ও বীজের বিধি বিধান তৈরি হয়েছে কৃষকের বীজ ব্যবস্থা ধ্বংস করে দেশী ও বহুজাতিক কোম্পানির বীজের বাজার প্রতিষ্ঠা করার জন্য। তাহলে আমাদের উচিত বীজ সংক্রান্ত সরকারী আইন ও বিধিবিধান এবং সামগ্রিক ভাবে তথাকথিত আধুনিক কৃষি ব্যবস্থাই যে কৃষির – বিশেষত বাংলাদেশের কৃষকের বীজ ব্যবস্থা রক্ষা ও বিকাশের প্রধান প্রতিবন্ধক সেটা পরিষ্কার উপলব্ধি করা।