
চা শ্রমিক এক নব্য দাস
যদি এখন শ্রমিকদের দৈনিক মজুরি ৭০০ টাকা হয় তবে চা শ্রমিকেরা কেন ১১০ টাকা দৈনিক ফ্যাক্টরি ছেড়ে শ্রমবাজারে গিয়ে শ্রম বেচে না ?
এই প্রশ্নের একটি সহজ ও মুখরোচক উত্তর হচ্ছে , শ্রমিকদের বিনামুল্য বা ভর্তুকির মদ দিয়ে নেশা গ্রস্ত বানিয়ে রাখা হয়েছে, ফলে, শ্রমিকেরা আর চা বাগানের বাহিরে গিয়ে কাজ করতে চায় না।
যুক্তিটি সঠিক, এই যুক্তিটি ব্যবহার করি কিন্তু, এইটার পেছনে আরো গভীর কিছু বিষয় আছে, যা ইন্টুইশান দিয়ে বোঝা সহজ নয় -ইটস কমপ্লেক্স।
চা শ্রমিকদের চা বাগান ছাড়তে না পারার বড় কারন রেশন। ইউ সি এই রেশনের যুক্তি দিয়েই, বাগান মালিকেরা বেতন কম রাখে বা রাখতে পারে। এই রেশনটার কারণে, চা শ্রমিক ১২০ টাকা বেতনে না খেয়ে মরে যায় না।
কিন্তু, এই রেশন টা না নিয়ে যদি চা শ্রমিক ৪০০ টাকায় বা আরো অধিক দৈনিক মজুরিতে বেতন পেত। তবে সে সেই টাকাটা মাল্টিপ্লাই করতে পারতো।
মনে করুন, একটা গরু পেলে বা সবজি ফলিয়ে, অথবা সেভিংস করে। যে সেভিংস টা মাইগ্রেশানের জন্যে ক্রিটিকাল। (এই প্রশ্নে পরে আসছি।)। অধিকাংশ চা বাগানে কোন গরু বা ছাগল দেখিনি। হতে পারে চা বাগানে গরু, চা গাছ খেয়ে ফেলবে বলে গরু ছাগল পালন করতে দেওয়া হয় না কিন্তু, ক্যাপ্টিভ ফারমিং ও তো করা যায়। কিন্তু খুব সম্ভবত অধিকাংশ বাগানের সেই অনুমতি নেই। অথচ, বাংলাদেশের গ্রামাঞ্ছলের পুজির বড় উৎস প্রোটিন ফারমিং।
দারিদ্র্য বিমোচন নিয়ে বিভিন্ন গবেষণায় এইটা স্পস্ট যে, দরিদ্রদের কে বিভিন্ন ধরনের পন্য বা দ্রব্য না দিয়ে যদি ক্যাশ টাকা দেওয়া হয় তবে সেইটা তাদের সব চেয়ে বেশী উপকারে আসে। কারন একজন দরিদ্র ব্যক্তি জানে, কীভাবে তার পরিবারের জন্যে সেই টাকার সর্বোচ্চ উপযোগিতা আসবে।
সে জানে আধপেটা খেয়ে টাকা টা তার সন্তানের জন্যে ভালো স্কুলে ব্যয় করবে নাকি মাসে একবেলা প্রোটিন খাবে।
কিন্তু রেশন দেই, তাই বেতন বেশী দিতে হয় না, এই যুক্তিতে পুরো চা শ্রমিকদের কোন ধরনের পুঁজি সঞ্ছয় করতে দেওয়া হয় নাই। বাংলাদেশের বিগত ৫ বছরে যে ইনফ্লেশান ছিল, সে অবস্থায় ১২০ টাকা কোন টাকাই না। এইটাতে কোন মতেই সেভিংস হবেনা।
এইটার আরো অনেক ইমপ্লিকেশান আছে। ইউ সি মাইগ্রেশান এমন ভাবে হয় না, যে একজন ব্যক্তির কোন উপার্জন নেই, সেই সব কিছু ছেড়ে ঢাকার বস্তিতে চলে আসলো।
মাইগ্রেশান করতে হলেও, একজন দরিদ্র ব্যক্তির বাসের ভাড়া, ঢাকা শহরে কয়েক মাস টিকে থাকার মত পুঁজি থাকতে হয়।
ফলে, চা শ্রমিকদেরকে রেশন দেই , তাই বেতন বেশী দেই না, এই যুক্তিতে নামমাত্র মজুরি দিয়ে, রেশান দেওয়ার মাধ্যমে চা বাগান মালিকেরা নব্য দাস প্রথার মজা নিয়ে যাচ্ছেন l শ্রমিক চাইলেও মুক্তি পেতে পারেনা। কারন বাগান থেকে বের হয়ে সে ঢাকায় এক মাস জব হান্টিং করবে, সেই সেভিংস টাও তার থাকেনা।
দ্বিতীয়ত, মাইগ্রেশনের জন্যে একটা কন্টাক্ট থাকতে হয়, যে তাকে ঢাকা শহরে পথ দেখাবে , যে তাকে এক মাস তার নিজের ঘরে থাকতে দিবে বা কোন গারমেন্টসে শ্রমিক নিচ্ছে সেই গারমেন্টসের এইছআরে দরোজা পর্যন্ত নিয়ে যেতে পারবে।
কিন্তু চা শ্রমিকেরা যেহেতু কোন জেনারেশানেই, মাইগ্রেট করে নাই, তাদের সেই কন্টাক্ট টাই থাকে না , তাই তাদের সাহস ও থাকেনা মাইগ্রেট করার।
তৃতীয় বিষয়টি আরো কমপ্লেক্স, বাঙালীরা চা শ্রমিকদের সামাজিক ভাবে নিচু জাত হিসেবে ট্রিট করে। চা শ্রমিকেরা মদ খায়, শুকর পালে, শুকর খায় এবং এমন কি তাদের গাত্র বর্ণ অধিক গাঢ়। ফলে চা শ্রমিকদের বিরুদ্ধে বাঙালীদের একটি বর্ণবাদী দৃষ্টি ভংগি আছে l
ফলে, সে ইন্সটুটুইশানালি রেসিস্ট বাঙালীদের মাঝে গিয়ে ঢাকা শহরে একটা বস্তিতে থাকতে পারবে, একটা চাকুরি খুজে পাবে, সেই খানে জীবন যাপন করতে পারবে এই বিশ্বাস তাদের নেই। মে বি তাদের মধ্যে কেউ কেউ মাইগ্রেট করার চেষ্টা করেছে এবং তাদের বরং আরো দেনার দায়ে জর্জরিত হয়ে ফিরে আসতে হয়েছে।
ফলে, এর সব কিছু মিলিয়ে একজন চা শ্রমিকের জন্যে, মাইগ্রেট করার হয়তো সুযোগ নেই।
কিন্তু আমি আপনার যুক্তিকে প্রশ্ন করতে চাই। কেন আপনাকে প্রশ্ন করতে হবে যে, একজন চা শ্রমিক চা বাগান ছেড়ে ডেইলি লেবারি করে না কেন ?
কেন আপনি প্রশ্ন করবেন না, বিলিয়ন বিলিয়ন টাকা প্রফিট করা মালিকের দায় আছে, একজন শ্রমিককে তার ন্যায্য মজুরি দেওয়ার। কারন ১১০ টাকা বা রেশনের খরছ যুক্ত করে, দৈনিক ২০০ টাকা কোন মতেই, ন্যায্য মজুরি নয়।
অন্যদিকে চা শ্রমিকরা মুলত চেতনায় দাসত্ব – এটি তার অযোগ্যতা নয় এটি হচ্ছে দীর্ঘদিন একটি আর্তসামাজিক পরিক্ক্রমা l যেহেতু এরা মাইগ্রেটেট তাই মুলধারার জনপদের সাথে এদের অনেকদিন বিচ্ছিন্ন করে রাখা হয়েছে l তাই এই পাহাড় ঘেরা জীবন ও সংস্কৃতি থেকেও এদের বের হওয়ার আগ্রহ নেই l
তবে চা শিল্প টিকিয়ে রাখতে হলে চা বাগান মালিকদের এই দিকে দৃষ্টি দিতে হবে l আজ হোক কাল হোক মুক্ত শ্রমের বাজারে এই শ্রমিকরা চলে আসবেই l
সংবাদ সংগ্রহ কৃতজ্ঞতা জিয়া হাসান