শুকনাছড়ি বনভূমি : এক্সডক্স বা স্বেচ্ছানির্বাসন আমার বেদনার রঙে পৃথিবী হলো লাল //মনির ইউসুফ//

সবুজের এত উজ্জ্বলতা আর সময়ের এত বর্ণিল বেদনা কোন বনভূমি বুঝি বহন করেনি। আকাশে দিগন্তের বিস্তার আর মৃত্তিকাজুড়ে বঙ্গোপসাগরের সীমা অনন্তের বুকে নিয়েছে ঠাঁই৷ আমি শুকনাছড়ি পাহাড়ে বসে এই স্বপ্নশোভিত প্রকৃতিকে বুকে জড়িয়ে ধরেছি কতোবার। কত শতবার আমি মনের জগতে ঘ্রাণ নিয়েছি এই পাহাড়ি আবরণে। পাহাড়ের সবুজ ঘাসে বসে মিশেছি ঘাসের শিরায়। সে অনুভবের বিস্ময়ে এ জীবন কেটেছে মুগ্ধ সৌন্দর্যে আর আমার পা মাটিকে ছুঁয়েছে পুলকের শির শির অনুভূতির আবেশে, আমি কি এই প্রত্নমগ্ন আবেশে কাতর! বঙ্গোপসাগরীয় সন্তানদের মধ্যে শুকনোছড়ি মনোভূমিতে এসে কে হয়নি কাতর? এ বনভূমি আমাদের বুকের আত্মার প্রলেপ। এখানে কত হজার বৃক্ষ, লতা, ভেষজ ঔষধী গাছ, গুল্ম সাগরের পাদদেশে মৎস্যকন্যার রহস্য কুন্তল। পাখির কলরব, বনপশুর চিৎকার, ঝর্নার উচ্ছ্বল কান্না। উপরে বনভূমির প্রাগৈতিহাসিক উত্তাল পাহাড়ি বাতাসের দোলা, নিচে সমুদ্রের সাত সাগরের তাজা হাওয়ার ঝিরিঝিরি আলোড়ন। সংবেদনময়ী মানুষের অদৃশ্য মন, এমন ভূমা আমাদের একটি জীবন । এত সম্পদ, এত বনজ বৃক্ষ, বৃক্ষদেবী, এত ভেষজপাতা আর এত তাজা অক্সিজেন শুকনোছড়ি আমাদের দিয়েছে- এ ঋণ আমরা কি করে শোধ করি। ছোটকাল থেকে যে মায়া, আদর, স্বস্তি, সৌন্দর্য, স্বপ্ন, কল্পনা আর জলপনার রশদ জুগিয়েছে এই পাহাড় তা ফেলে কোথায় বা যাব? হিমপরীর গল্প থেকে কানারাজার গুহার উপাখ্যান হয়ে এই পাহাড় আমাদের দিয়েছে কিচ্ছার অফুরন্ত ভান্ডার। বঙ্গোপসারের তীর পাহাড়ের তটে পাদদেশ দিয়ে মেরিন ড্রাইভ হওয়ার আগে এটা কত দুর্গম বনভূমি ছিল তা কি কল্পনা করা যায়! জীবন অন্বেষণে এই পাহাড় আমাদের যে অন্তর-আলোর অনন্ত পথ দেখিয়েছে, বনের প্রকৃতির সঙ্গে মনের প্রকৃতির বোঝাপড়া করতে শিখিয়েছে আমি তা কেমনে ভুলবো! পাহাড়ের ভেতর দিয়ে যে পথ গেছে সে পথ দিয়ে যেতে যেতে পাহাড়ে যাদের বসতি তাদের চোখের দিকে তাকানোই যাচ্ছে না। অসহায়, মরা দৃষ্টি, বোবা কষ্ট। শত বছরের মাটি ঘ্রাণ ছেড়ে তল্পিতল্পা গুটিয়ে চলে যেতে হবে অনিদির্ষ্ট কোথায়! এ তো বিতাড়ন। স্বেচ্ছায় চলে যাওয়ার নির্দেশ। আমাদের অভ্যন্তরীণভাবে উদ্বাস্তু করে দিচ্ছে। এ তো সিরিয়া, রোহিঙ্গা, ইয়েমেন, ইরাকের শরণার্থী মতই একই সিলসিলা। ওদেরকে কর্পোরেট যুদ্ধের মধ্যদিয়ে উদ্বাস্তু করে দিয়েছে, আমাদের কর্পোরেট সহিংস লোভে এক্সডক্স বা স্বেচ্ছায় নির্বাসনে বাধ্য করা হচ্ছে। দুটোই নির্বাসন, দুটোই একসূত্রে গাথা। এই নীতি নির্ধারণে জনগণের মতামতের কোন গুরত্ব দেওয়া হয় না, চাপিয়ে দেওয়া হয়। যুদ্ধ নির্বাসন রক্ত দ্বীর্ঘশ্বাস, হাহাকার, প্রতিবাদ, প্রতিরোধ ইত্যাদিকে কোন আমলে নেয় না জনগণের সন্তানরা। তারা ভুলে যায় তাদের আত্মীয়-স্বজন এই মাটির জনগণ, তারা সব পৃথিবীর সন্তান, তারাও জনগণ। কিন্তু কেউ কেউ এমন এরা প্রশাসক বা জনগণের সেবক, শাসকদের কেরানি, হুকুমের দাস ক্ষণিকের লোভের মোহে ইতিহাসের সব ইতিবাচক সত্যের সলিল সমাধী ঘটিয়ে এরা তাদের বেয়াড়া সিদ্ধান্ত নিয়ে এগিয়ে যায়, পৃথিবীর লাভের নামে নিজেদেরই লাভ করে। আর পৃথিবী ধ্বসে পড়ে প্রতারণার বোদনায়, মানুষ ও প্রকৃতির প্রতি এদের বেঈমানী ধরন দেখে পৃথিবী কুকড়ে যায়। কখনো কখনো বিদ্রোহ করে। সে অনেক দেরি হয়ে পড়ে। ততদিনে সাধারণ মানুষ ঘরছাড়া ভিটেছড়া দেশহারা হয়ে লুটিয়ে পড়ে মনের দেশে। ভাঙাচুরা মন নিয়ে কি প্রতিবাদ করবে তারা! যেখানে নিজের দেশের ভাইবেরাদর রক্তচক্ষুর ক্রুর দৃষ্টিতে তাকে ঘায়েল করে ফেলে। তাই বলে কি প্রতিবাদ, প্রতিরোধ, আন্দোলন ইত্যাদি মানুষ করবে না! অবশ্যই করবে। ঢাল তলোয়ার গা গতরে কাপড়হীন নগ্ন একজন স্পার্টাকাস যেমন এত বড় রোম সাম্রাজ্যের শাসনের ভিত কাঁপিয়ে দিয়েছিল, কল্পনা করুন, একজন গ্লাডিয়ের্টস নগ্ন একজন ক্রীতদাস শাসকদের নাকানিচুবানি খাইয়ে ছেড়েছিল
আর আমরা নিজেদের ভূমিপুত্র বলে দাবি করছি, নিজেদের আঞ্চলিকত্ব, কক্সবাজারজ্যাহ বলি গর্ব করছি, এখন আমাদের গর্ব গেল কোথায়? কক্সবাজার উন্নয়নের অধিকারে প্রকৃতি তছনছ হয়ে পড়লো, ভেঙে পড়লো, যে বা যারা যখন শাসন ক্ষমতায় থেকেছে, তারা তখন এই ভূমি লুট করেছে। কাকে দোষ দিবেন। আমাদের স্থানীয় এবং সাবেক সংসদ সদস্যদের কাজ কি? তারা কি ভাগভাটোয়ারার অংশীদার! হলেও হতে পারে। তারা নিরব কেন? আমাদের মেয়র মহোদয়ের এ বিষয়ে পাহাড় রক্ষার পক্ষে কোন বিবৃতি-প্রতিবাদ নাই কেন? আমাদের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ আজকে কোথায়? কক্সবাজারের ভূমির বেনিফিসিয়ারী তো তারাই। তারাই তো সব ভোগদখল করে রেখেছে। আজকে পাহাড় ধরে টান দিছে। কালকে আপনাদের ভিটে ধরে টান দিবে। তখন কোথায় যাবেন? আজকে জনগণ ও প্রকৃতির বিপদে আপনারা নিরব। সেদিন জনগণ আপনাদের থু থু তো দিবে, সবকিছুর হিসেব নেবে, যেদিন আপনারা নিজেরাও বিপদে পড়বেন। সুতরাং সময় থাকতে মাতৃভূমির রক্ষার জন্য আন্দোলন, প্রতিবাদ, প্রতিরোধের ডাক দিন। পার্টি হয়তো কিছুদিনের জন্য আপনাকে নেতা বানাবে, কিন্তু জনগণ আপনাকে সারাজীবনের জন্য নেতা করে রাখবে। কক্সবাজারের বিপদে দাঁড়ান, কক্সবাজার ও আপনাদের বিপদে দাঁড়াবে। জন্মভূমি কি? জন্মভূমি হচ্ছে স্বর্গ থেকে গরিয়সী। সে স্বর্গ দখল হয়ে যাচ্ছে আপনি কথা বলছেন না, তাহলে কোন স্বর্গ গিয়ে আপনি কথা বলবেন। সেখানেও তো আপনারা নিরব থাকবেন কায়েমী স্বার্থ ধ্বংস হবে বলে। তাহলে জগতের ষোলআনাই কি প্রতারণা! দেশের প্রতি দশের প্রতি আপনাদের সত্যিকারের কতর্ব্য পালন করার সময় এসেছে, সুতরাং কতর্ব্য পালন করুন।

লেখক: মনির ইউসুফ

সম্পাদক-কবিতার রাজপথ

সমন্বয়ক-বিপ্লবী লেখক আন্দোলন।

 

 

 

 

Sharing is caring!

Related Articles

Back to top button