
ইতিহাস-ঐতিহ্য ও জীববৈচিত্র্য সি,আর,বি//ফরহাদ জামান জনি
সিআরবি (সেন্ট্রাল রেলওয়ে বিল্ডিং) বাংলাদেশ রেলওয়ের (পূর্বাঞ্চলীয়) মহাব্যবস্থাপকের নিয়ন্ত্রণ কার্যালয়। চট্টগ্রামের যে অল্প কয়েকটা ভবন ব্রিটিশ উপনিবেশের সময়কে মনে করিয়ে দেয়, সিআরবি তার মধ্যে অন্যতম । ১৮৭২ সালে সম্পূর্ণ হওয়া ভবনটি আসাম-বেঙ্গল রেলওয়ের সদর দপ্তর হিসেবে যাত্রা শুরু করে তৎকালীন অবিভক্ত ভারতের যোগাযোগ ব্যবস্থা ভূমিকাকে সামনে রেখে। বর্তমানে বাংলাদেশ রেলওয়ের (পূর্বাঞ্চলীয়) কার্যালয় হিসেবেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে এই ঐতিহাসিক ভবনটি। ৭১’ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় এই এলাকাটির ভূমিকা ছিলো অপরিসীম। যুদ্ধের সময় মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় ও পরিকল্পনার জন্য এই স্থানটি ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। মুক্তিযুদ্ধে ১০ জন বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন সিআরবি এলাকায়। তার মধ্যে বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ আবদুর রব (জিএস-চাকসু) ও বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ নজির আহমেদের কবরস্থানও অত্র এলাকায় অবস্থিত।
কেবল ইতিহাস-ঐতিহ্য নয়; সিআরবি এলাকাটির প্রাণ-প্রকৃতি এবং জীববৈচিত্র্য পরিবেশের জন্য যেমন গুরুত্বপূর্ণ সে সাথে চট্টগ্রামকে করেছে আরো বৈচিত্র্যময় । সিআরবির পুরো এলাকা জুড়ে রয়েছে শতবর্ষী রেইন ট্রি আর শিরীষের সাথে আছে জারুল , নিম,সেগুন , পিটালি, ডুমুর, কড়ই, পাকুর এমনকি আম-জাম। ছোট ছোট পাহাড় ,টিলা আর উপত্যকা মিলিয়ে পুরো এলাকা যেনো সবুজের অভয়ারণ্য । আঁকাবাঁকা পিচ ডালা সড়কের দুপাশে দাঁড়িয়ে আছে শতবর্ষী রেইন ট্রি এবং শিরীষ গাছ ।এই শতবর্ষী গাছগুলো এই শহরের সংগ্রাম, স্লোগান, প্রেমসহ অসংখ্যা পরিবর্তনের স্বাক্ষী । এখন পর্যন্ত সিআরবিতে মোট ২২৩ টি উদ্ভিদ প্রজাতি তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে । যার মধ্যে রয়েছে বড় বৃক্ষ ৮৮ টি প্রজাতির , গুল্ম প্রজাতি আছে ৩৪ টি, লতা প্রজাতি উদ্ভিদ ২২ টি , বিপন্ন প্রজাতির উদ্ভিদ ৯ টি এবং ভবিষ্যতে বিলুপ্ত হতে পারে একরকম উদ্ভিদ ৬৬ টি ।
এসব বৃক্ষগুলোর মধ্যে ১৮৩ টি ঔষধি। এসব বৃক্ষগুলো বিভিন্ন রোগের ওষুধ হিসেবে ব্যবহৃত হয় । বনৌওষধির পাশাপাশি মেডিকেল সায়েন্সের ওষুধের জন্য ব্যবহ্নত হয় এসব বৃক্ষ ।বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সিআরবি দেশে প্রথম পাওয়া গেল- এমন কোনো প্রজাতিও মিলতে পারে । শতবর্ষী যে রেইনট্রিগুলো রয়েছে সেগুলোতে রয়েছে বহু ধরণের পরগাছা , যেমন – ছত্রাক, শৈবাল,অর্কিডসহ নানা পরজীবীর বসবাস । যেগুলোর সংখ্যা শতাধিক হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে । এসব শতবর্ষী কাঁটা বা বেঁচে থাকার প্রক্রিয়ায় বাঁধাগ্রস্ত হলে এসব প্রজাতি ধ্বংস হয়ে যাবে । গাছে অনেক কীটপতঙ্গ বসবাস করে । যারা ফুলের মধু আহরণের সময় পরাগায়ণ ঘটাত যাতে উদ্ভিদের বংশবিস্তার ঘটে । পুরো একটা ইকো -সিস্টেম । এসব গাছপালাকে কেন্দ্র করে সাপ, ব্যাঙ, নানা রকম পাখির বিচরণ ক্ষেত্রে তৈরী হয়েছে ।
দৃষ্টিনন্দন নির্মাণশৈলী’র জন্য পুরো সিআরবি এলাকার লাল ভবনগুলো বিখ্যাত ।বিশেষ করে চোখে পড়ে হাতি বাংলো । হাতির আদলে তৈরী করা বলে বাংলোর এমন নাম । এই বাংলোটা সাধারণ মানুষের জন্য আকর্ষণীয় জায়গায় , নির্মাণশৈলীর জন্য স্থপতিদের কাছেও খুবই গুরুত্বপূর্ণ ।
ইট-পাথরে ঘেরা এই শহরের ক্লান্তিকর জীবনে সিআরবি এলাকা নগরবাসীকে দেয় স্বস্তির নিঃশ্বাস। শিশু থেকে বৃদ্ধ, শ্রমিক থেকে চাকরিজীবী, শহরের সব স্তরের মানুষের প্রাণের জায়গা এই সিআরবি। প্রতিদিন শহরের নানা প্রান্ত থেকে অসংখ্য মানুষ আসে এই এলাকায়। খেলাধুলা, শরীরচর্চা, সাইকেলিং, আড্ডার মধ্য দিয়ে মাতিয়ে রাখে সন্ধ্যা অবধি। নগরের সাংস্কৃতিক কর্মীদের জন্য জায়গাটা হয়ে উঠেছে খুব গুরুত্বপূর্ণ। নববর্ষ বরণ, পহেলা ফাল্গুনের অনুষ্ঠানসহ বছরজুড়ে নানা আয়োজন হয় এই সিআরবিতে। ইতিহাস-ঐতিহ্য, প্রকৃতি ও সাংস্কৃতিক দিক থেকে নানা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে এই সিআরবি ।
২০২০ সালের ১৮ মার্চ পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপের (পিপিপি) ভিত্তিতে ইউনাইটেড হাসপাতাল পরিচালনা কর্তৃপক্ষ ইউনাইটেড এন্টারপ্রাইজ অ্যান্ড কোম্পানির সাথে একটা চুক্তি করে বাংলাদেশ রেলওয়ে। এই চুক্তিতে সিআরবি’র ৬ একর জায়গায় নিয়ে ইউনাইটেড এন্টারপ্রাইজ নির্মাণ করবে ৫০০ শয্যার ব্যাণিজ্যিক হাসপাতাল ও নার্সিং কলেজসহ নানা স্থাপনা। শুরু থেকেই চট্টগ্রামের জনগণ এই চুক্তি বাতিলের দাবি জানিয়ে আসছে। ওই বছরের মার্চ মাসেই চট্টগ্রামের বেশকিছু সংগঠন চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাব চত্বরে সমাবেশ করে সিআরবিতে হাসপাতাল করার যে উদ্যোগ তা বাতিল করার দাবি জানান। পরবর্তিতে এই হাসপাতাল নির্মাণ তৎপরতা বন্ধ থাকে। সম্প্রতি ইউনাইটেড গ্রুপ সিআরবি সাতরাস্তার মোড়ে হাসপাতাল নির্মাণের বিশাল বিলবোর্ড লাগালে চট্টগ্রামের বিভিন্ন স্তরের জনগণ আবারও ক্ষব্ধু হয়ে উঠে। সামাজিক যোগাযোগের নানা মাধ্যমে অবিলম্বে হাসপাতাল নির্মাণ তৎপরতা বন্ধের দাবি উঠে। গত ১৪ জুলাই গণসংহতি আন্দোলন চট্টগ্রাম জেলা শাখা চট্টগ্রামের জনগণদের সাথে সিআরবি এলাকায় মানববন্ধন করে। পরবর্তিতে বিভিন্ন রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, পরিবেশবাদী সংগঠনসহ অনেকে সিআরবি এলাকায় জড়ো হয়ে এই হাসপাতাল নির্মাণ তৎপরতা বন্ধের দাবি জানিয়ে আসছে—যা এখনো পর্যন্ত চলমান। সিআরবি রক্ষা মঞ্চ এবং নাগরিক সমাজ— এই দুই সংগঠন চট্টগ্রামের বিভিন্ন সংগঠন ও নাগরিকদের ঐক্যবদ্ধ করে সিআরবিতে হাসপাতাল নির্মাণ তৎপরতা বাতিল না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেয়।
আন্দোলনকারী সংগঠন ও নাগরিকরা বলছেন, সিআরবি চট্টগ্রামের ফুসফুস। এখানে হাসপাতাল ও নার্সিং কলেজ নির্মাণ হলে কাটা পড়বে শতবর্ষী গাছসহ ছোট বড় অসংখ্য বৃক্ষ, হুমকির মধ্যে পড়বে এখানকার জীববৈচিত্র্য। শুধু প্রাকৃতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে তা নয়, ঝুঁকির মধ্যে পড়বে ঐতিহ্যের সাক্ষী শত বছর ধরে দাঁড়িয়ে থাকা নানা ভবন। মুক্তিযুদ্ধে নিহত শহীদদের কবরস্থানও পড়বে হুমকির মধ্যে। হাসপাতালগামী অসংখ্য অ্যাম্বুলেন্সের আসা-যাওয়া, হাসপাতালকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা অসংখ্য ফার্মেসি বাধাগ্রস্ত করবে এখানে ঘুরতে আসা লোকজনদের। বন্ধ হয়ে যাবে বছর জুড়ে চলা নানা সাংস্কৃতিক আয়োজন। বিশেষ করে গত ১০-১২ বছর ধরে চট্টগ্রাম তথা বাংলাদেশের অন্যতম বৃহৎ নববর্ষ অনুষ্ঠান আয়োজন হয়ে আসছে এই সিআরবিতে। হাসপাতাল হলে বন্ধ হয়ে যাবে এই আয়োজনও।
চট্টগ্রাম শহর একসময় তার প্রাণ-প্রকৃতি নিয়ে গর্ব করতো, গর্ব করতো দেশসেরা অসংখ্য শিল্পী-খেলোয়াড়দের নিয়ে । কিন্তু গত ২০-২৫ বছর ধরে আস্তে আস্তে এর সবকিছু নাই হয়ে যাচ্ছে। তার অন্যতম কারণ, শহরে সংস্কৃতি চর্চা, খেলাধুলার জায়গাগুলো দখল হয়ে যাওয়া। গত ১৫ বছরের মধ্যে দখল হয়ে গেছে অসংখ্য পার্ক ও খোলা মাঠ। যা কিছু অবশিষ্ট আছে সে সব জায়গাগুলোতেও রয়েছে নানা বিধিনিষেধ। শহরের নাগরিকেরা সবকিছু হারাতে হারাতে সবশেষে সিআরবিকে আকঁড়ে ধরে বেঁচে আছে। নাগরিক জীবনের সমস্ত যন্ত্রণা, অপমান এই এলাকায় এসে ছুঁড়ে ফেলে আবার নতুন করে শুরু করার প্রাণ পায়। সিডিএ (চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ) এই এলাকার ইতিহাস-ঐতিহ্য, প্রাকৃতিক ও সামাজিক গুরুত্ব বিবেচনা করে ১৯৯৫ সালে তাদের তৈরীকৃত মহাপরিকল্পনায় সিআরবি এলাকাকে “স্ট্রাটেজিক ওপেন স্পেস” হিসেবে ঘোষণা করে। পরিবেশ, ঐতিহ্যসহ সবদিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ এই জায়গাতে ইউনাইটেড গ্রুপের এই হাসপাতালসহ যেকোনো ধরনের অবকাঠামো নির্মাণ বন্ধের দাবি জানান চট্টগ্রামের নাগরিকগণ ।
এই শহরে হাসপাতাল অবশ্যই দরকার। হাসপাতালের প্রয়োজনীয়তা করোনা মহামারীও আমাদেরকে আরো বেশী করে স্মরণ করিয়ে দিয়েছে। তবে চট্টগ্রামের ফুসফুসখ্যাত সিআরবিকে হুমকির মধ্যে ফেলে হাসপাতাল চায় না। কোনো ব্যাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানকে না দিয়ে সরকারের উদ্যোগে প্রাণ-প্রকৃতি ঠিক রেখে শহরের অন্যকোনো জায়গায় হাসপাতাল করার দাবি সর্বস্তরের মানুষের।
সিআরবি চট্টগ্রামের প্রাকৃতিক হাসপাতাল, তাই এই হাসপাতাল কোনোভাবেই ধ্বংস হতে দেওয়া যাবে না।
লেখক: ফরহাদ জামান জনি
সদস্য সচিব-গণসংহতি আন্দোলন চট্টগ্রাম জেলা