
তাল গাছ লাগিয়ে বজ্রপাত হতে মৃত্যুর হার কমিয়ে আনা যাবে
বজ্রপাত
দিনাজপুরের অধিবাসী Suchi Parvin এর তথ্য মতে একটি পুকুরের পাশে বাঁশের তৈরি মাচায় বসে মোবাইল গেম খেলার সময় বজ্রপাতের আঘাতে ঘটনাস্থলেই ৪ জন ও হসপিটালে নেওয়ার পরে আরও ১ জন মারা যায়। Dinajpur 360 নামক ফেসবুক পেজের তথ্য অনুসারে “চিরিরবন্দর উপজেলায় আরো ৩জন যুবক বরশী দিয়ে পুকুর পাঁড়ে মাছ ধরার সময় বজ্রাঘাতে নিহত হয়েছেন।” বজ্রপাতের সময় পানি যুক্ত স্থান যেমন পুকুর, ডোবা, নদী, ইত্যাদির কাছে থাকা খুবই বিপদজনক। পানির অনবিক গঠন পর্যবেক্ষণ করে দেখা যায় যে পানির অণুতে ধনাত্মক ও ঋনাত্নক প্রান্তের সৃষ্টি হয় রাসায়নিক পরিভাষায় যাকে ডাইপোল বলে। মেঘের গোঁড়ার দিকে যে চিহ্নের বৈদ্যুতিক চার্জ সৃষ্টি হয় (সাধারণত ঋনাত্নক) পা-নিযুক্ত স্থানের পৃষ্ঠে খুব সহজে তার বিপরীতমুখী চার্জ সৃষ্টি হয় (ধনাত্মক)। পা-নিযুক্ত স্থানের পৃষ্ঠ যেহেতু সমতল থাকে তাই বিশাল একটি স্থান জুড়ে সুষম ভাবে ধনাত্মক চার্জ যুক্ত পৃষ্ঠের সৃষ্টি হয় প্রাকৃতিক ভাবে। মেঘের গোঁড়া থেকে যখন ঋনাত্নক চার্জ ভূ-পৃষ্ঠের দিকে নামতে থাকে তখন পানির যুক্ত স্থানের উপরের ধনাত্মক চার্জ যুক্ত স্হনের শক্তিশালী ধনাত্মক চার্য মেঘের ঋনাত্নক চার্জকে নিজের দিকে প্রচণ্ড শক্তিতে টানতে থাকে। আমাদের বাসা-বাড়িতে যে বিদ্যুৎ ব্যব হার করি তা ২২০ ভোল্টের; বাড়িতে যে বৈদ্যুতিক লাইন থাকে বিদ্যুৎ আসে সেই বৈদ্যুতিক লাইনের বিদ্যুৎ হলও ১১ হাজার ভোল্টের, খুবই উঁচু বৈদ্যুতিক টাওয়ার (জাতীয় গ্রিড) এর বিদ্যুৎ ৩৩ হাজার ভোল্টের। কিন্তু বজ্রপাতের কারণে যে বিদ্যুৎ সৃষ্টি হয় তার মান শুরুই হয় ১০ হাজার ভোল্ট থেকে ও এর মান ২ বা ৩ লক্ষ ভোল্ট পর্যন্ত হতে পারে। আমি নিজে এই বছর বাংলাদেশের জামালপুর জেলার যমুনা নদীর চরে একটি বজ্রপাত থেকে ১ লক্ষ ৬ হাজার ভোল্টের বজ্রপাত পর্যবেক্ষণ করেছি। আমি আশাকরি ব্যাখ্যা করতে পেরেছি বজ্রপাতের সময় পানি যুক্ত স্থান যেমন পুকুর, ডোবা, নদী, ইত্যাদির কাছে থাকা কেন খুবই বিপদজনক।
এই বছর মে মাসের ১২ তারিখে বজ্রপাত সহ বৃষ্টির সময় খোলা মাঠে ফুট বল খেলার ঝুঁকি নিয়ে নিম্নোক্ত স্টাটাস দিয়েছিলাম “কালবৈশাখী ঝড় এর মৌসুমে বজ্র বৃষ্টি এর সময় মাঠে খেলা করা মানে নিজের জীবন নিয়ে খেলা করা। আমি নিজেও স্কুল জীবনে এই কাজ করেছি তবে তখন জানতাম না যে এই সময় মাঠে খেলা করা খুবই বিপদজনক।”
জাপান ও বাংলাদেশের গবেষকদের একটি গবেষণা দেখা গেছে বাংলাদেশে প্রধানত বজ্রপাত সহ বৃষ্টি হয় বর্ষা মৌসুমের শুরুর ৩ মাস (মার্চ-এপ্রিল-মে) ও বর্ষা মৌসুমের শেষের ২ মাস (সেপ্টেম্বর-অক্টোবর)। এই গবেষণা টিমের একজন সদস্য ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ও বর্তমানে অস্ট্রেলিয়ার কার্টিন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক Ashraf Dewan স্যার। এই মাসে চাঁপাইনবাবগঞ্জে ১৭ জন ও দিনাজপুরে ৭ জন, সর্বমোট ২৪ জন মানুষ মারা গেল। বজ্রপাতের কারণে এই দুইটি মৃত্যুর ঘটনাই ঘটেছে জন সচেতনতার অভাবে। চাঁপাইনবাবগঞ্জের ঘটনা টি ঘটেছে নদী পারাপারের ঘাটে ছোট খুপরি ঘরে অপেক্ষারত বরযাত্রী দলের সদস্যদের মৃত্যু হয়েছে। সম্ভবত নদীর পারের ঐ খুপরি ঘরটি ছিলও ঐ স্থানে সবচেয়ে উঁচু স্থানও বজ্রপাতের ঝুঁকি ঐ স্থানেই ছিলও সর্বোচ্চ। একই ভাবে খোলা মাঠ হলও বজ্রপাতের ঝুঁকির সর্বোচ্চ স্থান। আমার বিশ্বাস যে মানুষরা মারা গেছে তাদের কেউই জানতো না যে তারা বজ্র বৃষ্টির সময়ে যে স্থানে আশ্রয় নিয়েছে বা যে স্থানে ফুটবল খেলেছে সেই দুইটি স্থানই বজ্রপাতের ঝুঁকির সর্বোচ্চ স্থান।
বাংলাদেশ অপেক্ষা প্রায় ৫ গুন বেশি বজ্রপাত হয় আমেরিকায়; জনসংখ্যাও বাংলাদেশ অপেক্ষা প্রায় দ্বিগুণ। বাংলাদেশের বছরে বজ্রপাতে মারা যায় প্রায় ২৫০ থেকে ৩৫০ জন; বিপরীত-ক্রমে আমেরিকায় মারা যায় মাত্র ৩৫ জন। বজ্রপাত যুক্ত মেঘের সৃষ্টির জন্য যে ৪ টি পূর্ব শর্ত রয়েছে তার ৩টিই বৃদ্ধি পাচ্ছে বাংলাদেশের উপরে বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে। ফলে বজ্রপাত বিষয়ে মৃত্যু হার কমাতে চাইলে বাংলাদেশের স্কুল পর্যায়ের বিজ্ঞান বই বজ্রপাত বিজ্ঞান বিষয়ক একটি অধ্যায় যুক্ত করতে হবে ও প্রতিটি স্কুলের বিজ্ঞান বিষয়ক শিক্ষককে বিশেষ ট্রেনিং এর মাধ্যমে বজ্রপাত বিষয়ে প্রকৃত জ্ঞান প্রদান করার ব্যবস্হা করতে হবে। তাল গাছ লাগিয়ে বজ্রপাত হতে মৃত্যুর হার কমিয়ে আনা যাবে না। এই সত্যটি বাংলাদেশের সরকার যত দ্রুত বুঝতে পারবে তত দ্রুত বাংলাদেশের মানুষকে বজ্রপাতের কারণে মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করতে পারবে বলে মনে করি।
লেখক: মোস্তফা কামাল পলাশ
গবেষক ও আবহাওয়াবিদ