করোনা: জনগণের জীবন নিয়ে জুয়া খেলছে সরকার! আবু নাসের অনীক

 

বৈজ্ঞানিক তথ্য-উপাত্তকে পাশ কাটিয়ে বিধিনিষেধ শিথিল করে দেয়া হল। শিথিল বলা হলেও, কার্যত আগামী কয়েকদিনে নুন্যতম কোন বিধিনিষেধ কেউই প্রতিপালন করবে না। নিকট অতীতের অভিজ্ঞতা তাই বলে! সংক্রমণের বর্তমান পরিস্থিতির অন্যতম কারণ গত ঈদকে সামনে নিয়ে একই রকম ভাবে বিধিনিষেধ তুলে দেওয়া। গতবারের তুলনায় পরিস্থিতি আরো বেশি নাজুক করে তুলবে কারণ ইতিমধ্যে সংক্রমণ প্রত্যন্ত গ্রামে ছড়িয়ে পড়েছে।

লকডাউন শিথিলে জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটি’র প্রতিক্রিয়া,‘এ সময় আমাদের আরোও কঠোর হওয়ার কথা থাকলেও একে একে সব খুলে দেওয়ার সিদ্ধান্তে আমরা হতভম্ব। কারণ আমাদের জনগণ স্বাস্থ্যবিধি একেবারেই মানে না। মাস্ক পরা আমরা শতভাগ নিশ্চিত করতে পারিনি। সংক্রমণের এই মুহুর্তে শিথিলতা আগামীর দিনগুলো আরো ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠার ইঙ্গিত দিচ্ছে’। আমাদেরকে এমন ‘হতভম্ব’ হয়েই দিনাতিপাত করতে হবে।

সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে একটা দেশে কোন মুহুর্তে লকডাউন করা হয়? কখন সেটি প্রত্যাহার হয়? প্রত্যাহারের গাইডলাইন কী? এর একটি প্রশ্নেরও সদুত্তর আমাদের সরকারের কাছে নেই। সংক্রমণ যখন চুড়ান্তভাবে নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়ে, দেশের জনগণকে সাধারণ নির্দেশনায় স্বাস্থ্যবিধি প্রতিপালন করানো যায় না, গোটা স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ব্যাপক চাপে পড়ে যায়, ঠিক এমন মুহুর্তেই লকডাউনের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়।

লকডাউন কোনভাবেই সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণের স্থায়ী পদ্ধতি নয়। সংক্রমণের চুড়ান্ত বিস্তার ঘটে মানুষের চলাচলে। সাময়িকভাবে চলাচল বন্ধ হলে সংক্রমণ বিস্তারের চক্রকে ভেঙে দেওয়া যায়। চেইন ভেঙে দিতে পারলে এটা ক্রমশই নিম্নমুখী হতে থাকে। এই সময়ে (লকডাউনকালীন) স্বাস্থ্যসেবার যে জায়গায় গ্যাপ আছে সেগুলি পূরণ করা। বাড়তি রোগীর চাপ মোকাবিলায় যাতে সামর্থ্য অর্জন করা সম্ভব হয়। অন্তত রোগীর চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করা, যাতে চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত হয়ে কাউকে মৃত্যুবরণ করতে না হয়। লকডাউন সেই কাজগুলি করার জন্য স্পেস তৈরি করে দেয়, স্বাস্থ্যকর্মীরা যাতে মানসিক-শারীরিক চাপ সামলে নিরবিচ্ছিন্নভাবে সেবা দিতে পারে সেই পরিবেশ তৈরি করে। এই সকল বিষয় করোনা সংক্রমণ প্রতিরোধে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু।

জনস্বাস্থ্যবিদগণ লকডাউন শিথিলে কেনো হতভম্ব হলেন? ঢাকায় এই মুহুর্তে সরকারী হাসপাতালে খালি আইসিইউ বেডের সংখ্যা ৬৬ টি। ঢাকায় সরকারী- বেসরকারী মিলিয়ে আইসিইউ খালি আছে মাত্র ১৮%। সারাদেশে সরকারী-বেসরকারী পর্যায়ে সাধারণ বেড খালি আছে ৩১%, আইসিইউ খালি আছে ২০%(প্রকৃত সংখ্যা এর চাইতেও কম)। সারা জুন মাসে যে পরিমান রোগী শনাক্ত হয়েছে, সেই পরিমান শনাক্ত হয়েছে জুলাই ১৪ তারিখ পর্যন্ত (স্বাস্থ্য অধিদপ্তর-১৫/৭/২১)।

নতুন সংক্রমণে বিশ্বে (২২০ টি দেশ) বাংলাদেশের অবস্থান ৬ষ্ঠ, নতুন মৃত্যুতে ৪র্থ, সক্রিয় সংক্রমণে ১৪তম। মুমূর্ষু রোগীর হিসাবে ১৫তম, পার মিলিয়ন টেস্টে শেষের দিক থেকে অবস্থান ১৭১তম (ওয়ার্ল্ডো মিটার-১৫/৭/২১)। গত ৮-১৪ জুলাই এক সপ্তাহে গড় সংক্রমণ ১৩ হাজার ৫১৭, সংক্রমণের হার ৩০.৭৬%। গড় মৃত্যু ২০৮, মৃত্যুর হার ১.৭৫% (স্বাস্থ্য অধিদপ্তর)। সংক্রমণ পরিস্থিতির এ সকল তথ্য-উপাত্তের কারণেই আগামী দিনের ভয়াবহতা আঁচ করেই জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞগণ লকডাউন প্রত্যাহারের সিদ্ধান্তে হতবাক হয়েছেন!

বিধিনিষেধ শিথিলের মাধ্যমে চরম অরাজক পরিস্থিতি তৈরি করা হল। শহর-গ্রাম থেকে হাজার হাজার মানুষ এই আট দিনের জন্য ঢাকায় ঢুকছে। আবার একই রকম ভাবে বের হবে। খুলনা থেকে ঢাকামুখী একজন যাত্রী বলেন,‘করোনা নিয়ে আমাগো চিন্তা করে লাভ নাই। আমরা মালিকের কাম করি। বিধিনিষেধের কারণে মালিকে ১৪ দিনের ছুটি দিছে। তাই বাড়িতে আইছিলাম। এখন আবার ঢাকায় যাই। ঈদে ছুটি পাইলে আবার দেশে আসমু’(প্রথম আলো-১৫/৭/২১)। অতি উচ্চ সংক্রমিত এলাকা থেকে ঢাকায় ছুটে আসছে। সংক্রমণের বীজ বোপিত হবে, সেটা আবার চারা হয়ে ছড়িয়ে পড়বে সারা দেশে! জেনে বুঝে একটা মেসাকার তৈরি করা!!

সরকারের পরিকল্পনা অনুসারে, আগামী ২৩ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট লকডাউন হবে। শিল্প-কারখানাও এর আওতায় পড়বে। এই ঘোষণা শোনা মাত্রই, দেশের শ্রমিকদের নিয়ে সবচেয়ে ভাবিত সেক্টর গার্মেন্টস মালিক’রা (যারা প্রায়শই শ্রমিকদের ন্যায্য পাওনা বেতন সময়মত পরিশোধ করে না) সরকারের সাথে দেনদরবার শুরু করেছে। সরকারকে বোঝানোর চেষ্টা করছে, লকডাউনে যদি গার্মেন্টস খোলা না থাকে তাহলে শ্রমিক’রা মারাত্বক স্বাস্থ্য ঝুঁকির মধ্যে পড়বে!! শ্রমিকদের রক্ষা করার জন্যই করখানা খোলা রাখতে হবে!!!

দেশের জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞগণ বলছেন, সংক্রমণের গতি রুদ্ধ করার জন্য সবকিছু বন্ধ করতে হবে। সেখানে গার্মেন্টস মালিকদের অবস্থান পুরোটাই বিপরীতমুখী। এবং সরকার জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতামত ইগনোর করে মালিকদের মতামতকে শিরধার্য করছে। কারণ এরাই সরকারকে টিকিয়ে রেখেছে। জনস্বাস্থ্য টিকে থাকলো কি থাকলো না লুটেরা শাসকগোষ্ঠীর কাছে বিবেচ্য বিষয় হবে না, সেটাই স্বাভাবিক। সরকার করোনা প্রতিরোধ ব্যবস্থার যে ব্যবহারিক প্রয়োগ ঘটায় সেটা এই বেনিয়াদের পরামর্শে এটা স্পষ্ট একটি বিষয়।

বিকেএমই’র সহসভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেছেন,‘কারখানা দুই সপ্তাহ বন্ধ থাকলে অনেকেই দেওলিয়া হয়ে যাবেন। কারণ মহামারিতে বিভিন্নভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হওয়ার পর আবার ঘুরে দাড়ানোর সুযোগ এসেছে’। দেওলিয়াই যদি হয়ে যাবেন দুই সপ্তাহে, তাহলে এই ব্যবসা করবার দরকার কী?? ব্যবসা করে যা মুনাফা করেন সেগুলো যায় কোথায়??? নাকি মুনাফা ছাড়াই ব্যবসা করেন!!

বক্তব্য শুনে মনে হয়, যারা দিন আনে দিন খায় এদের (গার্মেন্টস মালিক) অবস্থা তাদের চাইতেও খারাপ! ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছেন, সেই ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়ার জন্য ক্ষুদ্র অনেক সেক্টরকে বঞ্চিত করে সরকারের কাছ থেকে সবচেয়ে বেশি টাকা প্রণোদনা নিয়েছেন। করোনার ১৬ মাসের মধ্যে মাত্র ২ মাস ব্যতীত বাকি ১৪ মাসই কারখানা খোলা রেখেছেন। অথচ যারা ক্ষুদ্র শিল্প, ছোট উদ্যোক্তা তারা এর চাইতে কয়েকগুন বেশি সাফারার হয়েছে। দেশে যদি সংক্রমণ পরিস্থিতি ডেট্রয়েট করে বায়াররা অটোমেটিক্যালি অর্ডার ক্যানসেল করবে।

চট্টগ্রামে’র পটিয়ার মহরম আলী মাছ বিক্রেতা। সংসারে তিন জনের ব্যয় বহনের জন্য সংক্রমণের এই অবস্থায় প্রতিদিনই বাইরে বেরিয়েছেন। জ্বর হয়েছে, তারপরেও বেরিয়েছেন, অবশেষে করোনায় আক্রান্ত। তিন দিন চিকিৎসা অতঃপর মৃত্যু। ১৫০০০ টাকা ধার করে চিকিৎসা ব্যয় মিটিয়েছে পরিবার। এখন হাসপাতাল থেকে লাশ বাড়ি নেবার অর্থও তাদের কাছে নেই! নওগাঁর মুজিবর রহমান, ফেরিওয়ালা। একই রকম ভাবে বিধিনিষেধ উপেক্ষা করে সংসারের ৩ জনের পেট চালানোর জন্য ফেরি করে পণ্য বিক্রি করেছে, সংক্রমিত হয়েছে। নওগাঁ থেকে রাজশাহী মেডিক্যালে ট্রলি থেকে নামাতেই মৃত্যু আলিঙ্গন করেছে তাকে (প্রথম আলো-১৫/৭/২১)।

মহরম আলী, মুজিবর রহমানের মত আরো অনেক মানুষ বিধিনিষেধ উপেক্ষা করে বেরিয়েছেন। ৩/৪ দিনের খাবার হয়তো জোগাড়ও করেছেন, কিন্তু বিনিময়ে নিজের জীবন হারিয়েছেন। আর স্ত্রী-সন্তানরা উপহার পেয়েছে একটা অনিশ্চিত বিভিষিকাময় জীবন। কারো হয়তো জীবন যায়নি, কিন্তু চিকিৎসা ব্যয় মেটাতে যেয়ে নিজের বসতবাড়ি বা আয়ের প্রধান উৎস একমাত্র অবলম্বন দোকানটিও ধরে রাখতে পারেনি বা পারছে না। এটি একটি ব্যয়বহুল চিকিৎসা। বহু মানুষ চিকিৎসা করাতে যেয়ে সর্বশান্ত হয়ে যাচ্ছে। তারপরেও হয়তো শেষ রক্ষা হচ্ছে না।

সরকার চাইলেই মহরম বা মুজিবরদের জীবন-সংসার রক্ষা করতে পারতো বা পারে। কিন্তু সরকার সে পথে হাটছে না। আর মহরম আলীরা জীবনকে জুয়ার গুটির মত বাজি ধরে এগিয়ে যাচ্ছে। সরকার বিশাল এক জুয়ার বোর্ড তৈরি করেছে। এই বোর্ডে ‘জীবন’ বাজি ধরে সর্বশান্ত হচ্ছে সাধারণ মানুষ। সমাজ জুয়া যারা খেলে তাদের গালাগাল করে, অভিযোগের তীর থাকে তাদের দিকেই। আর যে জুয়ার বোর্ড বসায়, সে থাকে ধরাছোয়ার বাইরে। তার কোন দায় খুঁজে পায় না সমাজ! এ ক্ষেত্রেও একি ঘটনা। সকল দায় জনগণের।

লকডাউন দিলেই আওয়াজ ওঠে, প্রান্তিক মানুষের খাবারের ব্যবস্থা করতে হবে। লকডাউন কার্যকর হচ্ছে না! আর লকডাউন না দিলে প্রান্তিক মানুষের দায় ঘাড় থেকে একেবারেই নামিয়ে ফেলা গেল! সংক্রমিত হও, মর-বাচোঁ সব দায় জনগণের। সরকারের মনোভাব, জুয়ার বোর্ড আছে, খেলবা কী খেলবা না সেটা এখন তোমার ইচ্ছা!! আমরা জানি, ক্ষতিগ্রস্থ হতে পারে, সর্বশান্ত হতে পারে, সেটা জানার পরেও জুয়াড়িরা খেলে। কারণ জুয়ার বোর্ড তাকে খেলতে আকৃষ্ট করে, প্রলুব্ধ করে!

সরকার জনবান্ধব হলে, এই পরিস্থিতিকে সফলভাবে মোকাবিলা করতে পারতো। সকলের সমন্বয়ে একটি সমন্বিত পরিকল্পনা গ্রহণ করা সম্ভব ছিল। অনলাইনে কোরবানীর পশু ইতিমধ্যে (২-১২ জুলাই) বিক্রি হয়েছে ১ লাখ ৫৭ হাজার ২৮৮ টি (প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর)। অনলাইনে হাটকে সীমাবদ্ধ রাখা গেলে মানুষ কোরবানীর পশু এখান থেকেই কিনতে বাধ্য হতো। তাতে হয়তো কিছু সমস্যা হতো, কিন্তু মহামারীর বিপর্যয় থেকে রক্ষা পাওয়া যেতো। সরকার কঠোর অবস্থানে থাকলে ঈদে বাড়ি যাওয়াও আটকানো সম্ভব ছিলো। কারণ তাদের সেই মেকানিজম আছে।

কিন্তু তারা সেটি না করে করোনা প্রতিরোধে তাদের সামগ্রীক ব্যর্থতাকে আড়াল করার জন্য জনগণের জীবন নিয়ে জুয়া খেলা শুরু করেছে। মানুষকে হাজার সর্তক করেও জুয়ার এই প্রলোভন থেকে রক্ষা করা যাবে না এটাই বাস্তবতা। সামনে একটি ভয়াবহ সময় অপেক্ষা করছে। তারপরেও বলা, নিজের আর চারপাশের মানুষকে রক্ষা করতে স্বাস্থ্যবিধি মানুন, বিপর্যয়কে রুখে দিন।

  1. লেখক: আবু নাসের অনীক

সাবেকসভাপতি-বিপ্লবী ছাত্র মৈত্রী

 

Sharing is caring!

Related Articles

Back to top button