
করোনা: এক অনির্দিষ্ট গন্তব্যে! আবু নাসের অনীক
স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেছেন,‘গ্রামের মানুষ করোনাকে স্বাভাবিক জ্বর-সর্দি ভাবছে’। মানুষকে এমন ভাবতে আপনারাই শিখিয়েছেন! আপনার ক্যাবিনেট সহকর্মী পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছিলেন,‘করোনা মারাত্বক রোগ নয়; এটা সর্দি-জ্বরের মতো’। স্মরণে আনুন, মাত্র এক মাস আগে আপনি নিজে বলেছিলেন,‘করোনা নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশ সফল’। বিবেচনা করুন, যে দেশে আপনাদের মতো মন্ত্রীবর্গ এ ধরনের বালখিল্য বক্তব্য দেন, সে দেশের গ্রামের সাধারণ মানুষ করোনাকে স্বাভাবিক জ্বর-সর্দি ভাববে এটাই তো স্বাভাবিক! এর দায় আপনাদেরই। সাধারণ জনগণের মধ্যে যে উপেক্ষার প্রবণতা, এটি তৈরি করার ক্ষেত্রে আপনাদের এধরনের বক্তব্য অনেকাংশেই দায়ি।
গত এক সপ্তাহে (৪-১০ জুলাই) দেশে গড়ে প্রতিদিন শনাক্ত হয়েছে ১০ হাজার ৪৩৭ জন, শনাক্তের হার ৩০.৭৭%। মৃত্যু হয়েছে ১৮২ জনের, মৃত্যুর হার ১.৭১%। শেষ ১ লাখ রোগী শনাক্ত হয়েছে গত ১০ দিনে (স্বাস্থ্য অধিদপ্তর)। দেশের হাসপাতালগুলোতে ইতিমধ্যে সাধারণ শয্যা থেকে আইসিইউ বেড পাওয়া যাচ্ছে না। হাসপাতালের বারান্দা ছাপিয়ে এখন রোগীর স্থান হচ্ছে গাছ তলায়।
পরিস্থিতি যখন এমন, সেই মুহুর্তে প্রকৃত চিত্র আড়াল করার চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। গত ৮ জুলাই, ২০২১ ঢাকা সিভিল সার্জন অফিস থেকে ‘বিষয়: ঢাকা জেলাধীন সরকারী হাসপাতাল সমূহে রোগীর সেবা সম্পর্কীয় ও স্বাস্থ্য বিষয় কর্মকান্ডের উপর কোন তথ্য আদান প্রদান ও মন্তব্য প্রিন্ট মিডিয়াকে না দেওয়া প্রসঙ্গে (স্মারক নং: সিএস/ঢাকা/ প্রশাসন শাখা/২০২১)’ একটি পরিপত্র জারি করা হয়েছে। পরিপত্রে সংবাদকর্মীদের ছবি তোলা, ভিডিও করা, সাক্ষাতকার নেওয়ার বিষয়ে বিরত থাকতে বলা হয়েছে। তথ্য দেওয়ার একমাত্র ব্যক্তি হিসাবে সিভিল সার্জন উল্লেখ করা হয়েছে।
দেশে সংক্রমণ শুরু হওয়ার পর থেকে যখনই সংকট ঘনিভূত হয়েছে তখনই এমন নিষেধাজ্ঞা এসেছে। সংক্রমণের এই ১৬ মাসে কয়েক বারই এমন পরিপত্র জারি হয়েছে। সরকারের কর্তৃত্ববাদী আচরণের বহিঃপ্রকাশ। তথ্যকে সংকুচিত করা। রোগীর ছবি তোলা, ভিডিও করা অথবা সাক্ষাতকার নেওয়াকে রোগীর ব্যক্তিগত গোপনীয়তা ভঙ্গের সামিল বলে উল্লেখ করা হয়েছে। সত্যিই কী তাই!! বরং ছবি তোলা, ভিডিও আর সাক্ষাতকারের মাধ্যমে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের অব্যবস্থাপনার আর ব্যর্থতার চিত্রটি জনসম্মুখে প্রকাশ হয়ে পড়ছে। সেটা ঠেকানোর উদ্দেশ্যেই এই পরিপত্র!
দেশের সরকারী হাসপাতালগুলোতে রেড ও ইয়োলো জোনে ভাগ করে করোনা সংক্রমিতদের চিকিৎসাসেবা প্রদান করা হচ্ছে। যাদের টেস্ট করা হয়নি, করোনা উপসর্গ আছে তাদের ইয়োলো জোনে ভর্তি করা হচ্ছে। এই জোনে ভর্তি হওয়া মাত্রই প্রথমে যেটি প্রয়োজন তার টেস্ট করা। কারণ এখানে করোনা সংক্রমিত এবং সংক্রমিত নয় উভয় রোগী একসাথে থাকছে। যিনি সংক্রমিত নন, তিনি এই ওয়ার্ডে থাকার কারণে সংক্রমিত হবার যথেষ্ঠ সম্ভাবনা তৈরি হয়। কিন্তু দ্রুত টেস্ট করাটি উপেক্ষিত হচ্ছে।
৩/৪ দিন অপেক্ষার পরেও টেস্ট হচ্ছে না। দেশে বর্তমানে নিশ্চিত মৃত্যুর চেয়ে ইয়োলে জোনে চিকিৎসারত অবস্থায় উপসর্গ নিয়ে মৃত্যু কোথাও কোথাও অনেক বেশি। গত দুই সপ্তাহে উপসর্গ নিয়ে মারা গেছে ৪৮৬ জন (সিজিএস)। রোগী ভর্তি হওয়া মাত্রই এ্যান্টিজেন টেস্ট করে আধা ঘন্টার মধ্যে ফলাফল জানা সম্ভব। অথচ অব্যবস্থাপনার কারণে অধিকাংশ সরকারি হাসপাতালে বিশেষকরে জেলা পর্যায়ে ইয়েলো জোনের রোগীদের এই টেস্টের মাধ্যমে শনাক্ত করা হচ্ছে না। দেরি করে যেমন নমুনা সংগ্রহ করা হচ্ছে, একইসাথে আরটিপিসিআর ল্যাবে পাঠানোর কারণে ফলাফল পেতে দেরি হচ্ছে। ফলশ্রুতিতে মূল চিকিৎসা দিতে দেরি হবার কারণে রোগীর পরিস্থিতি যেমন ক্রিটিক্যাল হচ্ছে, একইসাথে অসংক্রমিত রোগী, সংক্রমিত হচ্ছে।
একটি সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা থাকলে এ ধরনের সমস্যাগুলির সমাধান তাৎক্ষনিকভাবেই করা যায়। কিন্তু সরকার ব্যবস্থাপনা ঠিক করার পেছনে যতোটা সময় ব্যয় করে, তারচেয়ে বেশি সময় ব্যয় করে সংকটকে লুকিয়ে রাখার পেছনে। সরকারি হিসাবে স্বাস্থ্যমন্ত্রীর নিজ জেলা মানিকগঞ্জ সদর হাসপাতালে ৫ টি আইসিইউ বেড আছে। বাস্তবে যার একটিও ব্যবহার উপযোগী নয়। এই থাকার সাথে না থাকার মধ্যে কী কোন পার্থক্য আছে??
দেশে করোনা ডেডিকেটেড হাসপাতালের সংখ্যা ১০০। এর মধ্যে ৫২ টিতেই আইসিইউ নেই। মোট আইসিইউ এর ৭৫% আবার ঢাকা বিভাগে। যে ৪৮ টি হাসপাতালে আইসিইউ আছে তার মধ্যে একটি উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ব্যবহার অনুপযোগী। আইসিইউ ইউনিট পরিচালনার জন্য শয্যার পাশাপাশি অন্য যে সমস্ত শর্ত (দক্ষ চিকিৎসক, অবেদনবিদ, দক্ষ নার্স, সেন্ট্রাল অক্সিজেন ব্যবস্থা/ হাই ফ্লো ন্যাজাল ক্যানুলা প্রভৃতি) পূরণ হওয়া প্রয়োজন সেগুলির অভাবে এগুলো অকার্যকর থাকছে। অর্থাৎ স্বাস্থ্য অধিদপ্তর যে হিসাব প্রতিদিন প্রদান করছে, প্রকৃত পরিস্থিতি তারচেয়ে অনেক বেশি খারাপ। যে দুটি বিভাগে এখন মৃত্যু বেশি তার ১৮ টি জেলার মধ্যে ১০ টিতেই আইসিইউ নেই। এই দুই বিভাগে মৃত্যু বেশি হবার এটিও একটি কারণ।
১ তারিখ থেকে শুরু হওয়া লকডাউন ধীরে ধীরে শিথিল হয়ে পড়ছে। প্রধান সড়কগুলোতে যেমন গাড়ীর চাপ, একইরকমভাবে অলিতে-গলিতে মানুষের চলাচল। ডিএমপি সূত্রে জানা যায়, ১-১০ জুলাই লকডাউনকালীন সময়ে বিধি-নিষেধ অমান্য করে যানবহন চলাচলের কারণে ৪ হাজার ৭১৪ টি যানবহনকে ১৩ কোটি ৭৭ লাখ ৮ হাজার ৯২৫ টাকা জরিমানা করা হয়। মাস্ক না পরাসহ বিভিন্ন বিধি-নিষেধ ভঙ্গের কারণে ২ হাজার ৪২৩ ব্যক্তিকে ২৬ লাখ ৪১ হাজার ৯৫০ টাকা জরিমানা, ৬ হাজার ৫৬০ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়।
একই রকম ভাবে সারা দেশেও স্থানীয় পুলিশ প্রশাসন ও র্যাব অভিযান পরিচালনা করছে। গ্রেপ্তার ও জরিমানা করছে। লক্ষণীয় বিষয়, ব্যক্তিগত গাড়ি চলাচল করছে বেশি। তারা বড় অংকের জরিমানার সম্মুখীন হবার পরেও আইন ভঙ্গ করে চলেছে। আইনের নির্মোহ প্রয়োগ না হবার কারণেই তারা আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করছে। অন্যদিকে সাধারণ জনগণ জরিমানা ও জেলের সম্মুখীন হবার পরেও আইন মানছে না। অর্ধাৎ যে লকডাউনটি বাস্তবায়ন করা হচ্ছে এটি জনবান্ধব নয়। জনসম্পৃক্ততা নেই।
ফলশ্রুতিতে এই লকডাউন সঠিকভাবে কার্যকর হবার কোন সম্ভাবনা নেই। সেকারণেই সংক্রমণের গতি নিয়ন্ত্রণে এটি প্রত্যাশিত কার্যকর ভূমিকা রাখতে ব্যর্থ হবে। ফলাফল পাওয়া যাবে আংশিক। সংক্রমণ পরিস্থিতি আরো দীর্ঘায়িত হবে। এটা পরিস্কার যে, আমলাতন্ত্র আর প্রশাসনিক ব্যবস্থায় বাংলাদেশের মতো দেশে কোনভাবেই লকডাউন শতভাগ কার্যকর হওয়া সম্ভব নয়। যেহেতু কার্যকর হবে না, ফলাফলে সামনে বিপর্যয় আরো বেশি প্রকট আকার ধারণ করবে।
অবশেষে ১৬ মাস পার করে কেবল প্রস্তাবনা নেওয়া হয়েছে, করোনা সংক্রমণ মোকাবিলায় মাঠ পর্যায়ে সচেতনতা বৃদ্ধিসহ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে ইউনিয়নে ও ওয়ার্ড পর্যায়ে জনপ্রতিনিধিদের নেতৃতে কমিটি গঠন করা হবে। সংক্রমণ শুরুর পর থেকে জনস্বাস্থ্যবিদগণ এ বিষযে বারংবার পরামর্শ দেবার পরেও ইগনোর করা হয়েছে। এই কাজটি করতে পারলে বর্তমানের এই বিপর্যয়কর পরিস্থিতি অনেকাংশে এড়ানো সম্ভব হতো। জাতীয় পর্যায়েও একইভাবে সকল রাজনৈতিক দলের সমন্বয়ে একটি সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ করা অতি জরুরি একটি কাজ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সেটিই বলছে বারবার।
গত এপ্রিল মাসে ফিল্ড হাসপাতালের বিষয়ে প্রস্তাবনা গ্রহণ করলেও পরে সেটি শুধুমাত্র প্রস্তাবনাতেই থেকে যায়। সংক্রমণের বর্তমান স্তর মোকাবিলায় সবচেয়ে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে ফিল্ড হাসপাতাল। রাজধানী ও জেলাগুলোতে সরকারি ও বেসরকারি হাতপাতালে রোগী ভর্তি কঠিন হয়ে পড়ছে। এই অবস্থায় ফিল্ড হাসপাতাল থাকলে মানুষ এটার সাপোর্ট পাবে। দেশের বাস্তবতায় হোম আইসোলেশন একটি অবাস্তব বিষয়। ফিল্ড হাসপাতাল হলে রোগীকে প্রাতিষ্ঠানিক আইসোলেশনে রাখা সম্ভব হবে। ২৪ ঘন্টা চিকিৎসকের পর্যবেক্ষণে রাখা গেলে সংকটাপন্ন অবস্থা কাটানো সম্ভব হবে। কারণ আগেই ব্যবস্থা নিতে পারলে আইসিইউ প্রয়োজন অনেক কমে আসবে।
ফিল্ড হাসপাতালে প্রয়োজনীয় প্রাথমিক চিকিৎসা এবং অক্সিজেন সরবরাহের ব্যবস্থা রাখেতে হবে। রোগীর অবস্থা জটিল হলে হাসপাতালে রেফার করতে হবে। ফিল্ড হাসপাতালের সবচেয়ে বড় উপকারিতা রোগের সংক্রমণ বিস্তার প্রতিরোধ করা সম্ভব হয়। এই মুহুর্তে জেলায় জেলায় বিশেষকরে যেখানে সংক্রমণের হার বেশি সেখানে দ্রæত ফিল্ড হাসপাতাল করতে হবে আরো বড় বিপর্যয়কর পরিস্থিতি এড়ানোর জন্য।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মুখপাত্র অধ্যাপক ডা: মো: রোবেদ আমিন বলেন, ‘সংক্রমণ এখনও বেড়েই চলেছে। অনেক মানুষ মারা যাচ্ছে, হাসপাতালের সমস্ত খালি বেড পূর্ণ হয়ে যাচ্ছে। আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে যদি আমরা নিয়ন্ত্রণ করতে না পারি, পরিস্থিতি অত্যন্ত করুণ হয়ে যাবে। তখন সবাই মিলে বিপদে পড়ে যাওয়ার সম্ভবনা অনেক বেশি থাকবে’।
মাননীয়গণ, সংক্রমণ এক অনির্দিষ্ট গন্তব্যের দিকে ছুটে চলেছে। এর রাস টেনে ধরার এখনই সময়। সময় একবার চলে গেলে সে আর ফিরে আসে না।
“Time, you Old Gypsy Man/ Will you not stay,/ Put up your Caravan/ Just for one day?/ All things I’ll give you/ Will you be my guest,/ Bells for your jennet/ Of silver the best,/ Goldsmiths shall beat you/ A great golden ring” এতো অনুনয়ের পরেও তাকে থামানো যায়নি, থামানো যায় না!
লেখক: আবু নাসের অনীক
সাবেক সভাপতি-বিপ্লবী ছাত্র মৈত্রী