
ওয়াল্স ক্রেইট (কমন ক্রেইট) / কালাচ: আব্দুল্লাহ মারুফ
চলতি বর্ষায় যাদের থেকে সাবধান থাকবেন- ৩
ছোট বেলায় একবার আমাদের বাড়ির আঙিনায় স্তুপ করে রাখা পুরাতন ইটের গাদা পরিস্কার করতে গিয়ে আমার হাতে প্রায় কামড় খেয়ে গিয়েছিলাম কালাচ সাপের, আমাদের অঞ্চলে একে সাখাপাটি কানন নামে ডাকা হয়। আর একবার সন্ধ্যার পর বাড়িতে ঢুকতে বাড়ির দেউড়ির ভেতর প্রায় পায়ের নিচে পড়ে গিয়েছিলো এই সাপ, (উল্লেখ্য- দুটি ক্ষেত্রেই সাপ দুটি মারা পড়েছিলো )। এই সাপ সম্পর্কে আমার তখন পর্যন্ত কোনো বাস্তব ধারনা না থাকায় সেসময় তেমন একটা ভয় কাজ করেনি আমার ভেতর । এখন ভাবলেই শিউরে উঠি কত বড় বাঁচা বেঁচে গেছি দুই দুইবার !
সাধারন চোখে দেখতে শান্ত-শিষ্ট মনে হলেও দুই বাংলায় প্রতি বছর যত মানুষ সাপের কামড়ে মারা যায় তার সবচেয়ে বড় অংশই মারা যায় এই কালাচ সাপের কামড়ে। কোনো তর্জন-গর্জন নেই, গতিও খুব একটা বেশি নয়, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই লোক চক্ষুর আড়ালে লুকিয়ে থাকতে উস্তাদ এই সাপকেই ধরা হয় দুই বাংলার সর্পকূলের মধ্যে সবচেয়ে মারাত্মক সাপের একটি । কালাচের স্বভাবের কারনেই ব্যক্তিগতভাবে আমার ভেতর এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি ভয় কাজ করে এই নিরব ঘাতককে নিয়েই । একে বলা হয় সাইলেন্ট কিলার !
কালাচের মধ্যে মানুষের ঘরে ঢোকার প্রবনতা রয়েছে, দিনের বেলায় ঘরের কোনো অন্ধকার যায়গায় খুব সঙ্কুচিত হয়ে লুকিয়ে থাকে, রাতে বের হয় । সবচেয়ে ভয়ের ব্যাপার যেটা সেটা হলো এই ভদ্রলোকের স্বভাব মানুষকে ঘুমের ভেতর কামড় দেওয়া । গোখরা সাপকে যেমন বিরক্ত না করলে সাধারনত মানুষকে কামড় দেয়না, এই ভদ্রলোকের বেলায় এই তত্ব একেবারেই খাটে না ! যেনো মানুষকে কামড় দেওয়া এদের এক ধরনের সখ !
আরও যেটা ভয়ের ব্যাপার তা হলো- বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কালাচ সাপে কামড় দিলেও মানুষ সাধারনত বুঝতে পারেনা যে তাকে সাপে কামড়েছে ! বিষদাত খুব ছোট হওয়ায় ক্ষতস্থান খুব দ্রুত মিলিয়ে যায়, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কোনো রক্তক্ষরণও হয়না! এমনকি কালাচের কামড়ে তেমন কোনো জ্বালা-যন্ত্রনাও রোগী অনুভব করেনা ! মশা বা পিপড়ার কামড়ের সমান জ্বালা যন্ত্রনা হতে পারে বড়জোর। গোখরা সাপ যেমন শতকরা পচাশিভাগ ক্ষেত্রে ড্রাই বাইট করে বা কামড় দেয় কিন্তু বিষ প্রয়োগ করেনা, এই ভদ্রলোকের বেলায় এই তত্বও একেবারেই অচল, শতকরা আটানব্বই-নিরানব্বইভাগ কামড়েই এরা বিষ প্রয়োগ করে দেয়।
কালাচের বিষের তিব্রতাও গোখরার তুলনায় পনেরো গুন বেশি শক্তিশালী নিউরোটক্সিন !
একমাত্র ভালো খবর হলো- কালাচের বিষ অন্য সাপের তুলনায় ধীর গতির। এর কামড়ে বিষক্রিয়ার লক্ষন প্রকাশ পেতে সাধারনত ছয় ঘন্টা সময় দেয়। কামড়ের ঘন্টাছয়েক পর থেকে রোগীর তলপেটে তীব্র ব্যাথা শুরু হবে, রোগীর ঘুম ঘুম ভাব হবে, রোগীর চোখের পাতা বুজে আসতে চাইবে, বমি হবে বা বমি বমি ভাব হবে। যেহেতু কালাচের কামড়ে বেশিরভাগ রোগী বুঝতে পারেনা যে তাকে সাপে কামড়েছে, তেমন কোনো ক্ষতস্থানও থাকেনা, এবং এর বিষের প্রধান লক্ষনই হলো তলপেটে ব্যাথা হওয়া সেহেতু রোগী ডাক্তারের কাছে গেলে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ডাক্তার বুঝতে না পেরে রোগীকে পেটের অসুখের চিকিৎসা দিয়ে থাকেন, খুব অভিঞ্জ ডাক্তার ছাড়া কালাচের কামড় শনাক্ত করতে পারেনা সাধারনত। ফলাফল হয় বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই রোগীর মৃত্যু ।
যদি আপনি বুঝতে পারেন যে আপনাকে কালাচ সাপে কামড়েছে তবে যত দ্রুত সম্ভব নিকটস্থ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চলে যান । অন্য সাপের তুলনায় আপনি কালাচের ক্ষেত্রে একটু বেশি সময় পাবেন হাসপাতালে পৌছানোর জন্য, কালাচের কামড়ে কোনো কোনো রোগীকে ছত্রিশ ঘন্টা পর্যন্ত সারভাইভ করতেও দেখা গেছে । যেহেতু কালাচের বিষ ধীর গতিতে কাজ করে সেহেতু ভয় না পেয়ে যথাযথ চিকিৎসার সুযোগ অন্য সাপের তুলনায় বেশি রয়েছে বলে মনে করি ।
আমাদের দেশে কালাচের আরও একটি প্রজাতী রয়েছে- কৃষ্ণ কালাচ বা কাল কেউটে ( ব্ল্যাক ক্রেইট ) , ( ছোট কাল কেউটে এবং বড় কাল কেউটে )। আমি এই পোস্টে ব্ল্যাক ক্রেইটেরও একটি ছবি সংযোযন করেছি আপনাদের চেনার সুবিধার্থে। উল্লেখ্য- ব্ল্যাক ক্রেইটও কালাচের মতই বিষধর প্রজাতী তবে তারা সংখ্যায় কম ।
সঙ্খিনী নামে কেউটে প্রজাতীর আরও একটি সাপ রয়েছে যেটাকে এই ভূখন্ডের সবচেয়ে বিষধর ধরা হয়, তবে তারা স্বভাবে খুবই শান্ত, সঙ্খিনী সাপের মানুষকে কামড়ানোর প্রবনতা প্রায় নেই, তাদের কামড়ে বাংলাদেশে কোনো মানুষের মৃত্যুর রেকর্ডও নেই নিকট অতীতে। তাছাড়া সঙ্খিনী সাপ সমতল অঞ্চলে বাসও করে খুব কম। আমাদের অঞ্চলে সঙ্খিনী সাপ নেই। সিলেট-মৌলভীবাজার এবং পার্বত্ব চট্টগ্রাম অঞ্চলে সঙ্খিনী সাপ বেশি দেখা যায়। অতএব সঙ্খিনী নিয়ে আমাদের অঞ্চলের মানুষের চিন্তার কোনো কারন নেই।
মনে রাখবেন যেকোনো বিষধর সাপে কাটলে আপনার বা আপনার আপনজনের জীবন বাঁচানোর জন্য আপনার হাতে সময় থাকবে খুবই কম, প্রতিটি মুহুর্তই আপনার জন্য মহামুল্যবান, অতএব এই মহা মুল্যবান সময়ের একটি মুহুর্তও কোনো ওঝা-বদ্য-কবিরাজ-ঝাড়ফুক-গাছ গাছড়া-হাত চালান-কাটা ছেড়া করে নষ্ট করবেন না । তাতে রোগীর মৃত্যু নিশ্চিত করা ছাড়া কিছুই হবে না।
রোগীর ক্ষতস্থানের উপরে তিন/চার ইঞ্চি চওড়া কাপড় দিয়ে হালকা করে বেধে দিয়ে দ্রুতগামী যানবাহনে দ্রুত নিকটস্থ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চলে যান। সঠিক সময়ে সঠিক পদক্ষেপ নিতে পারলে আশা করা যায় আপনার রোগী চিকিৎসা পেয়ে সুস্থ হয়ে যাবে ।
সাপ আমাদের ইকোসিস্টেমের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপুর্ণ একটি উপকারী প্রাণী । সাপ দেখলেই মেরে না ফেলে তাড়িয়ে দিন বা নিকটস্থ রেসকিউয়ারকে খবর দিন।
বাড়ির আশপাশের ঝোপ জঙ্গল পরিস্কার রাখুন। বর্ষাকালে বাড়ির চারপাশে মাসে একবার ব্লিচিং পাউডার ছিটিয়ে দিন, এতে আপনি আশি শতাংশ নিরাপদ থাকবেন।
রাতে ঘুমানোর আগে বিছানাপত্র ঝেড়ে নিয়ে মশারী টানিয়ে ঘুমান।
লেখক: আব্দুল্লাহ মারুফ,কবি ও পরিবেশ কর্মী