করোনা: আমলা নির্ভর প্রতিরোধ ব্যবস্থা: আবু নাসের অনীক

 

গত কয়েক সপ্তাহ থেকে দেশের সংক্রমণ পরিস্থিতি ক্রমান্বয়ে খারপের দিকে। ধারনা করা যেতে পারে, দেশ অচিরেই আরো একটি ওয়েভের মুখোমুখি হতে চলেছে। পূর্বে শহুরে মানুষ সংক্রমণ ঝুঁকির মধ্যে থাকলেও বর্তমানে গ্রামাঞ্চলের মানুষও এই ঝুঁকির আওতায় রয়েছে।

‘গ্রামের মানুষের করোনা হয় না’ এই প্রচারণাকে অগ্রাহ্য করে প্রত্যন্ত গ্রামে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়েছে, মৃত্যুও ঘটছে। ডেলটা ভ্যারিয়েন্ট আধিপত্য বিস্তার করেছে শহরে ও গ্রামে। ঈদ পরবর্তী পরিস্থিতি এমন হবে সেটি জনস্বাস্থ্যবিদরা পূর্বেই সর্তক করেছিলেন। কিন্তু সরকারের কার্যকর ব্যবস্থার অভাবে সংক্রমণ পরিস্থিতি এতোটা নাজুক অবস্থায় পৌঁছেছে।

যেখানে শহরের নাগরিক ঠিকমত টেস্ট করাতে আগ্রহী হয় না, সেখানে গ্রামের পরিস্থিতি আরো বেশি খারাপ। এ বিষয়ে না শহরে না গ্রামে, কোন ধরনের সচেতনতামূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করা হচ্ছে না। অথচ শহরে-গ্রামে তৃণমূল পর্যায়ের জনপ্রতিনিধি, রাজনৈতিক-সামাজিক সংগঠন, বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার মাধ্যমে বাড়ি বাড়ি যেয়ে সচেতনতা গড়ে তোলা সম্ভব।

ভ্রান্ত দৃষ্টিভঙ্গির প্রভাবে, সঠিক পরিকল্পনার অভাবে এই কাজগুলি করা হচ্ছে না। জনসম্পৃক্ত প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে না তুলে আমলা নির্ভর ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়েছে। যার যেখানে কনট্রিবিউট করার সুযোগ ছিল সেটি অবরুদ্ধ করা হয়েছে। ফলশ্রুতিতে এই প্রতিরোধ ব্যবস্থা সংক্রমণ প্রতিরোধে ব্যর্থ হচ্ছে। সংক্রমণ প্রতিরোধে জেলাগুলিতে জনপ্রতিনিধিদের প্রধান দায়িত্বে না রেখে আমলাদেরকে প্রধান করে কমিটি করা হয়েছে। যাদের সাথে সাধারণ জনগণের কোন ধরনের সম্পর্ক নেই, থাকার কথাও নয়!

সরকার যে প্রশাসন-আমলা নির্ভর, সংক্রমণ প্রতিরোধ ব্যবস্থাপনায়ও তার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। অথচ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, জনসম্পৃক্ততা ব্যতীত সংক্রমণ প্রতিরোধ করা সম্ভব হবে না। কিন্তু সরকার সংক্রমণের শুরু থেকে অদ্যাবধি বিষয়টিকে গুরুত্বহীন করে রেখেছে।

WHO’এর COVID-19 Strategic Preparedness and Response Plan (1 February 21- 31 January 22) Part-II তে বলা হয়েছে,‘ Engage with community based and civil society organizations, including strengthening community-led research, response and inclusive participation in decision-making, planning, monitoring and accountability processes.’ সে অনুসারে সরকার যদি দেশের ক্রিয়াশীল রাজনৈতিক দল, সিভিল সোসাইটি অর্গনাইজেশনকে সম্পৃক্ত করে কর্মপস্থা নির্ধারণ করতো তবে, পরিস্থিতি অনেক আগেই নিয়ন্ত্রণের মধ্যে চলে আসা সম্ভব ছিল।

সংক্রমণ প্রতিরোধে ইতিপূর্বে কেন্দ্রীয়ভাবে লকডাউন করা হয়েছে। বর্তমানে আঞ্চলিকভাবে করা হচ্ছে। কিন্তু কেন্দ্রীয় ও আঞ্চলিক কোন পর্যায়েই লকডাইন সঠিকভাবে কার্যকর হচ্ছে না। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ৮ জন বিশেষজ্ঞের সমন্বয়ে লকডাউন কার্যকর করার জন্য গত বছরের জুনে একটি কৌশলপত্র তৈরি করা হয়।

লকডাউন বাস্তবায়ন কৌশলপত্রে ১২ টি করণীয় নির্ধারণ করা আছে। সেগুলি- স্থানীয় জনগোষ্ঠীকে সম্পৃক্ত করা, ঝুঁকি বিষয়ক যোগাযোগ, পর্যাপ্ত টেস্ট, আইসোলেশন, কন্ট্যাক্ট ট্রেসিং, খাদ্য ও সামাজিক সহায়তা, শতভাগ নাগরিকের মাস্ক ব্যবহার নিশ্চিত করা, সঠিক চিকিৎসা, মৃত্যু শূন্যে নামিয়ে আনা এবং সার্বক্ষনিক নজরদারি।

উল্লেখিত ১২ টি করণীয়’র একটিও যথাযথভাবে পালন করা হয় না। স্থানীয় জনগোষ্ঠী তো অনেক দুরের ব্যাপার, এমনকি জনপ্রতিনিধিদের কোন সম্পৃক্ততা নেই। পর্যাপ্ত টেস্ট হয় না। খাদ্য ও সামাজিক সহায়তার কোন কর্মসূচি নেই, জনপ্রতিনিধিদের যুক্ত না করলে সেটা সম্ভবও নয়। খুবই স্বল্প সংখ্যক মানুষ মাস্ক ব্যবহার করছে। চিকিৎসার যথাযথ ব্যবস্থা নেই। মৃত্যু শূন্যের বদলে প্রতিদিন বাড়ছে!!

করোনা সংক্রমণ বিস্তারের অন্যতম একটি কারণ আইসোলেশন ও কোয়ারেন্টাইন ঠিকমত না হওয়া। বাংলাদেশের বাস্তবতায় হোম আইসোলেশন প্রকৃতপক্ষে অবাস্তব বিষয়। দেশের অধিকাংশ বাসা-বাড়িগুলো বড় জোর ২/৩ রুম। এটাচবাথের সংখ্যা ১ টি। বাসাগুলোতে থাকে ৪ এর অধিক সংখ্যক সদস্য। এমন অবস্থায় হোমকোয়ারেন্টাইন এবং হোমআইসোলেশন কোনটাই ঠিকমত হয় না। ফলাফলে পরিবারে একজন আক্রান্ত হলে অন্য সদস্যরাও সংক্রমিত হয়ে পড়ছে। মফস্বলে এটি বেশি ঘটছে। এই পরিস্থিতি রোধ করারর জন্য প্রয়োজন প্রাতিষ্ঠানিক আইসোলেশন ও কোয়ারেন্টাইন এর ব্যবস্থা করা। সরকারের পক্ষ থেকে সুষ্ঠু পরিকল্পনা গ্রহণ করলেই এটা বাস্তবায়ন সম্ভব।

পর্যাপ্ত পরীক্ষার ঘাটতি রয়েছে এখনও। অথচ টেস্ট বাড়াতে না পারলে সংক্রমণের প্রকৃত চিত্র বোঝা সম্ভব নয়। প্রকৃত অবস্থা নির্ণয় করতে না পারলে প্রতিরোধ ব্যবস্থা হবে দূর্বল। সরকারের তরফ থেকে তথ্যের ব্যাপক ঘাটতি রয়েছে। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের মতো প্রকৃত তথ্য আড়াঁল করা হয়। যেকোন গণবিরোধী সরকারের কাজই হল জনগণের কাছ থেকে প্রকৃত তথ্য গোপন করে রাখা।

WHO’এর COVID-19 Strategic Preparedness and Response Plan (1 February 21- 31 January 22)’র Key Lessons and Challenges for 2021 অংশে উল্লেখ করছে,‘The infodemic of misinformation and disinformation, and a lack of access to credible information continue to shape perceptions and undermine the application of an evidence-based response and individuals risk-reducing behaviours. However empowered, engaged and enabled communities have played a key role in the control of COVID-19.’ এতোটা স্পষ্টভাবে বলার পরেও এসব বিষয় সরকারের কাছে গুরুত্বহীন। এরপরেও সরকার বলবে, করোনা নিয়ন্ত্রণে আন্তরিক!!

একটি অংশ প্রচারণা চালিয়েছিল, করোনা গ্রামে গরীব-প্রান্তিক মানুষের হয় না। এই রোগ শুধুমাত্র মধ্যবিত্ত আর উচ্চবিত্তের হয়, যারা এসিতে থাকেন। কিন্তু বর্তমান সংক্রমণ পরিস্থিতি তাদের এই প্রচারণাকে অসাড় প্রমান করেছে। রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের আইসিইউ ইনচার্জ ডা. আবু হেনা মোস্তফা কামাল বলেন,‘জুন মাসের শুরু থেকে তাঁরা ৩০-৪০ শতাংশ গ্রামের সাধারণ রোগী আইসিইউতে পাচ্ছেন, এরা সকলেই গ্রাম থেকে আসা দরিদ্র মানুষ’।

এদের পক্ষে চিকিৎসার ব্যয়ভার বহন করা এতোটাই অসম্ভব হয়ে পড়ছে যে, আইসিইউতে ভর্তি একজন রোগীর বোন বলছে, ছুটি দিয়ে দিতে, এই চিকিৎসার খরচ বহন করার সার্মথ্য তাদের নেই। আর ডাক্তার বলছে, মুখ থেকে মাস্ক খুলে নিলে এই মুহুর্তেই রোগীর মৃত্যু ঘটবে। অসচেতনতার কারণে এরা টেস্টও করাচ্ছে না। উপসর্গ নিয়ে মৃত্যু বেড়ে গেছে, মৃত্যু পরবর্তী টেস্টে ৯৯% করোনা পজিটিভ পাওয়া যাচ্ছে।

সংক্রমণ ক্রমেই নিয়ন্ত্রণের বাইরে যাচ্ছে। যেটুকু তথ্য (প্রকৃত তথ্য এর চেয়ে নাজুক) পাওয়া যাচ্ছে, সেটিই ইঙ্গিত করছে। গত এক সপ্তাহে এর আগের সাত দিনের তুলনায় শনাক্ত ৫৫.১৬% ও মৃত্যু ৪৬.৩০% বেড়েছে (স্বাস্থ্য অধিদপ্তর)। বিশ্ব পরিসংখ্যানে ২১৮ টি দেশের মধ্যে সংক্রমণে অবস্থান ৩১তম, নতুন সংক্রমণে ১০ম, নতুন মৃত্যুতে ৮ম, মোট মৃত্যুতে ৩৮তম, সক্রিয় সংক্রমণে ২৬তম, মৃত্যু ঝুঁকিপূর্ণ রোগীর সংখ্যায় ১৭তম, পারমিলিয়ন টেস্টে অবস্থান শেষের দিক থেকে ১৭৪তম (ওয়ার্ল্ডোমিটার-২০/০৬/২১)। এই তথ্য নির্দেশ করে করোনা পরিস্থিতিতে সমগ্র বিশ্বে আমাদের দেশ ঝুঁকিপূর্ণ বলয়ে অবস্থান করছে।

কিন্তু এসকল তথ্য-উপাত্ত সরকারের কাছে বিশেষ কোন প্রতিক্রিয়া তৈরি করছে না। তাদের অধিকাংশ কার্যক্রমই কার্যত লোক দেখানো, যা প্রতিরোধ ব্যবস্থায় উল্লেখযোগ্য কোন প্রভাব রাখছে না। যেমন- লকডাউন ঘোষণা করছে, কিন্তু বাস্তবায়ন হচ্ছে না। অনেকটা ‘দেখা যাচ্ছে কিন্তু ছোঁয়া যাচ্ছে না’র মতো। তার কারণে জনগণের মধ্যেও সংক্রমণ বিষয়ে কোন উদ্বিগ্নতা নেই। শুধুমাত্র ভূক্তভোগীরাই এর ভয়াবহ পরিণতি সম্পর্কে টের পাচ্ছে। এর মধ্যেই অনুষ্ঠিত হচ্ছে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন।

বাগেরহাটের মোংলায় একদিনের ব্যবধানে শনাক্তের হার ৪৬.৮৭% থেকে বেড়ে ৭৯.১৬% হয়েছে। কমিউনিটি লেভেলে একদিনের মধ্যে শনাক্তের হার এতোটা ফ্রাকচুয়েট করা এটা খুবই ভয়াবহ পরিস্থিতির ইঙ্গিত করে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মুখপাত্র বলেছেন, আমরা ঈদে বাড়ি না যাওয়ার জন্য নিরুৎসাহিত করছি। কী হাস্যকর! বর্তমান পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে বাড়ি যাওয়া, এটা কী উৎসাহিত অথবা নিরুৎসাহিত’র পর্যায়ে আছে??

সুনির্দিষ্টভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে বাড়ি যাওয়া যাবে, না যাবে না। তার জন্য যে যে ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন সেটা গ্রহণ করতে হবে। সরকার এখনও পর্যন্ত ‘শ্যাম রাখি না কুল রাখি’ অবস্থানে রয়েছে। যে অবস্থানের কারণে সংক্রমণ পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে এসেছে।

এই অবস্থান থেকে সরে এসে সুনির্দিষ্টভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে না পারলে সামনে পরিস্থিতি ভায়াবহ। যা কোনভাবেই মোকাবিলা করা সম্ভব হবে না। জনস্বাস্থ্যবিদ আবু জামিল ফয়সাল বলেন,‘ঢাকার বাইরে স্বাস্থ্যসেবা-সুবিধা অপ্রতুল। এখন সুবিধা আর খুব বেশি বাড়ানোর সুযোগও হয়তো কম। সংক্রমণ যত বাড়বে, মৃত্যুও তত বাড়বে। এই অপ্রতুল সুবিধা নিয়ে পরিস্থিতি মোকাবিলায় এখন রোগী ব্যবস্থাপনা এবং স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার ওপর বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে’।

আসলে কেই যদি ইচ্ছাকৃতভাবে বধির সেজে থাকে, তার কানের কাছে তীব্র চিৎকার করলেও সে শুনতে না পারার অভিনয়টাই চালিয়ে যায়!!

লেখক: আবু নাসের অনীক

সাবেক সভাপতি, বিপ্লবী ছাত্র মৈত্রী

Sharing is caring!

Related Articles

Back to top button