কড়ই গাছ: তারিকুল ইসলাম পলাশ

প্রাচীন যুগের ভারতীয় কবি কালিদাস খ্রিষ্টপূর্ব প্রথম শতকে কড়ই বা শিরীষকে চারুকর্ণের অলংকার বলে মেঘদূত কাব্যগ্রন্থে উল্লেখ করেছেন। তবুও ‘কড়ই’ গাছের আদি নিবাস নিয়ে মতপার্থক্য আছে। তবে নিশ্চিত বহু যুগ ধরে উদ্ভিদটি বাংলার প্রকৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ। কড়ই প্রতিকূল পরিবেশে সহজেই বিকশিত হতে পারে এবং নানান কাজে বহুল ব্যবহৃত হয় বিধায়, দেশের প্রায় অঞ্চলে উদ্ভিদটির দেখা মেলে। পরিবেশ ব্যবস্থাপনা, গবাদি প্রাণীর খাদ্য, ওষুধ, কাঠ ও ছায়া দানকারী উদ্ভিদ হিসেবে কড়ই গাছ লাগানো হয়। উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকা, বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানসহ অনেক দেশেই কড়ই স্বাভাবিক ভাবে জন্মায় এবং নার্সারিতে চারা উৎপন্ন হয়। ‘কড়ই’ এর প্রচলিত বাংলা নাম ; চটকা, শিরীষ, কালা কড়ই, কালি কড়ই, শীল কড়ই, সৃষ্টি কড়ই, ইত্যাদি। পোশাকি নাম রেইনট্রি, সব প্রজাতির সাধারণ নাম শিরীষ। স্থানীয়ভাবে শীল কড়ই নামে সমধিক পরিচিত। বৈজ্ঞানিক নাম Albizia lebbeck. ইংরেজি Lebbeck, Lebbek Tree, Flea Tree, Frywood, Koko বা Woman’s tongues Tree শব্দ থেকেই রেন্ডি গাছ নামকরণ হয়েছে বলে অনেকে ধারণা করেন। Albizia গোত্রর সকল প্রজাতির সাধারণ নাম শিরীষ।

অনেক আগে থেকেই নানা প্রজাতির কড়ই বা শিরীষ বৃক্ষ এই অঞ্চলে বিদ্যমান, বিধায় বৃক্ষটির কিছু প্রজাতির আদি নিবাস অবিভক্ত ভারত মহাদেশের বলে ধারণা করা হয়। শিরীষ ফুলের সৌন্দর্য সম্পর্কে কবিকুলের রচনা সুপ্রাচীন। চৈত্রের শেষে বৃষ্টিস্নাত ধরিত্রীর স্নেহস্পর্শে শিরীষের ফুল প্রস্ফুটিত হয়।

চিরহরিৎ শিরীষ গাছ সাধারণত ছায়াতরু হিসাবে পথের ধারে লাগানো হয়। গাছটি ১৮-৩০ মিটার পর্যন্ত লম্বা হতে পারে। পাতা গুলো ৭.৫-১৫ সেমি. ফুল লাল-সাদা বা সাদা-হালকা হলুদ অথবা হালকা সবুজ বর্ণের হয়ে থাকে। পুংকেশর ২.৫-৩.৮ সেমি. হয়। গাছের ফল ৮-১০ সেমি লম্বা, ৪-৬ সেমি চওড়া সাদা বা কালো চ্যাপ্টা, কিছু প্রজাতির কড়ই বীজের খোলার মধ্যে জেলির ন্যায় আঠালো পদার্থ থাকে। যা অনেক প্রজাতির পাখি ও প্রাণীদের প্রিয় খাদ্য। শুকনো ফল গাছে ঝুলতে থাকে। একসময় কড়ই ফলের বীজের খোলা শিশুরা উড়ন্ত খেলনা হিসেবে ব্যবহার করত। ফলের মাঝখানে বোতামের মতো গোল গোল বীজ থাকে। অনুকূল পরিবেশ পেলে প্রকৃতিগত ভাবে বীজ হতে চারা উৎপন্ন হয়।

অপরাহ্ণে ও বর্ষণমুখর পরিবেশে কড়ই গাছের পাতা পরস্পরকে আলিঙ্গন করে জল ধরে রাখে বিধায় গাছটি রেইন ট্রি বা বৃষ্টি গাছ নাম ধারন করেছে বলে অনেকের বিশ্বাস। অনেকেই চৈত্রের ভরদুপুরে রেইনট্রির শীতল ছায়া বটবৃক্ষ বলে ভুল করেন। অনেকের ধারণা কড়ই মেক্সিকো, ইন্দোমালয়, নিউগিনি ও উত্তর অস্ট্রেলিয়া অঞ্চলের উদ্ভিদ। আদি পুরুষ কখন কিভাবে পাক-ভারতে আশ্রয় নিয়েছিল তা অজ্ঞাত। অনেক ইতিহাসবিদ মনে করেন, প্রথম মোগল সম্রাট বাবরের আমলে মধ্য এশিয়ার সাথে ভারত বর্ষের যোগাযোগ বৃদ্ধির সময় বৃক্ষটির আগমন।

ব্রিটিশ শাসনামলে বড় বড় শহরের সড়কের ধার, কালেক্টর অফিসের সামনে ও সরকারি রেস্ট হাউজের আঙিনায় রেইনট্রি রোপণ ও রক্ষণাবেক্ষণ করা হতো। বছর কয়েক আগেও নারায়ণগঞ্জের বন্দরে বর্তমান ইস্পাহানি ঘাট এলাকায় রেইনট্রির কিছু প্রাচীন বংশধর ছিল। ইস্পাহানি গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ হাসিম ১৮২০ সালে ইস্পাহানি গ্রুপ প্রতিষ্ঠার সময়, ঐ এলাকায় বেশ কিছু রেইনট্রি গাছ রোপণ করেন। সত্তরের দশকে ইস্পাহানির অনেক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যায়। এরপর নব্বইয়ের দশকেও গাছগুলো দেখা গেছে। একেকটা গাছ একর জায়গা জুড়ে মহীরুহের মতো দাঁড়িয়ে ছিল। এক সময় গাছগুলো কর্তন করে দালান নির্মাণ করা হয়।

আরো জানা যায়, ১৭৯৩ সালে লর্ড কর্নওয়ালিস বাংলাকে তিনটি তালুকে ভাগ করে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত দেন। এক ভাগ ময়মনসিংহের ত্রিশালের জমিদার রাজনারায়ণ চক্রবর্তীর হয় । তিনি খাজনা আদায়ের জন্য গফরগাঁও উপজেলার দত্তের বাজার ইউনিয়নের কন্যামণ্ডলে কাচারি স্থাপন করেন, যা পরবর্তী সময়ে ‘যোগেশ বাবুর কাচারি’ নামে পরিচিতি লাভ করে। তিনি ১৭৯৫ সালের দিকে ভারত থেকে চারটি কড়ই বা রেইনট্রি, দু’টি বট, পাঁচটি আম ও শিমুল গাছ এনে কাচারির আঙিনায় রোপণ করেন। দু’টি কড়ই, একটি আম ও এক বটবৃক্ষ জীবিত আছে। এখনও প্রায় চারশ বছর আগের রেইনট্রি বংশধরের কয়েকটি ফেনীতে আছে। পুরাতন সোনাগাজী বাসস্ট্যান্ডের পাশের প্রাচীন গাছটি নিয়ে রয়েছে অনেক উপকথা-গল্প–কল্পকাহিনী!

ব্রিটিশ আমলে আদালত এলাকায় বিজ্ঞ আইনজীবীদের (উকিল) বসার তেমন কোনো ব্যবস্থা ছিল না। তাই প্রত্যেক আদালতের মাঠে ছিল প্রকাণ্ড বট, অশ্বত্থ, কড়ই কিংবা পাকুড় গাছ। সে সময় উকিলদের মধ্যে যারা মামলার কাজকর্ম গাছের ছায়ায় বসে করতেন, তাদের পরিচয় ছিল ‘বটতলার উকিল’

এই সমস্ত নানা কাহিনী লিখে শেষ করার নয়। তাই মূল প্রসঙ্গে আসা যাক; বৃহত্তর যশোর ও চুয়াডাঙ্গা অঞ্চলের রাজপথের ধার দিয়ে, একসময় প্রচুর পরিমাণ কড়ই গাছ ছিল। ইতিহাস হতে, এই বৃক্ষগুলোর খুব বেশি সুনির্দিষ্ট তথ্য পাওয়া যায় না। সমাজের প্রবীণ ও বিজ্ঞজনদের মুখে মুখে প্রচলিত, কেউ বলেন বিখ্যাত কড়ই গাছগুলি সম্রাট শের শাহ্ সুরি (১৪৮৬-১৫৪৫) তাঁর মায়ের পথের যাতায়াতের কষ্ট নিবারনের জন্য রোপণ করেছিলেন। তাই মহাসড়কটির নাম একদা ছিল শের শাহ্ সুরি সড়ক।

কথিত আছে, নলডাঙ্গার রাজা শ্রী বিষ্ণুদাস হাজরা তার মায়ের তীর্থ যাত্রা পথের কষ্ট লাঘবের জন্য এই গাছ গুলি লাগিয়ে ছিলেন। তখন সড়কটির নাম ছিল গ্রান্ড ট্রাঙ্ক রোড। কেউ বলেন সড়কটি দিল্লী পর্যন্ত আবার কেউ বলেন আফগানিস্তান পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। যাই হোক বিষয়টি জ্ঞানী গুণী ইতিহাসবিদদের বিষয়। আশা করি ইতিহাসবিদরা, এই বিভ্রান্তি দুর করতে সহায়তা করবেন। প্রচলিত প্রবাদ ‘মোল্লার দৌড় মসজিদ পর্যন্ত’ বিধায়, সমাজ ভাবনায়;

ইতিহাস যাই হোক না কেন। বাংলাদেশ-ভারতের সেতু বন্ধনকারী ঐতিহাসিক ঘটনাবহুল যশোর রোডের রাস্তার দু’ ধারে সারি সারি কড়ই গাছগুলি ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে আজও কিছু স্বগর্বে মাথা উঁচু করে দাড়িয়ে আছে। যশোর-বেনাপোল মহাসড়কে সুদীর্ঘ কড়ই গাছের সারি থেকে সৃষ্টি হয়েছে সবুজের সমারোহ। এ মহাসড়কে ০৯ লক্ষ ১২ হাজার স্কয়ার বিস্তৃত ক্যানোপি বা সবুজ পাতার আচ্ছাদন রয়েছে। সবুজের এই আচ্ছাদন ছায়া দেওয়ার পাশাপাশি সূর্যের অতি বেগুনি রশ্মি থেকে জীবকূলকে রক্ষা করে। বায়ু ও শব্দ দূষণ নিয়ন্ত্রণ করে। ওজন স্তরের ভারসাম্য রক্ষা ও তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা রাখে।

একসময় প্রাচীন কড়ই গাছগুলো নিয়ে ছিল নানা কল্পকাহিনী। প্রায় নাকি হরহামেশাই চোখে পড়তো; গাছ গুলোকে ঘিরে নানা রহস্যময় প্রাণীদের আনাগোনা, আগুনের গোল্লার ছোটাছুটি, গাছের ডালে সাদা কাপড় পরা জ্বীন-পরী, ভূত-পেত্নীর নাচানাচি। তাই শিশুতোষ মনে তৈরি হয় মনঃ ভয়। এমনকি নির্জন রাস্তায় দিনের বেলাতেও দুর্বল চিত্তের মানুষদের কড়ই গাছকে ভয় পেতে দেখা গেছে। তবে সন্ধ্যা হলেই শুরু হতো কড়ই গাছে পাখিদের মিলনমেলা। পাখির কলকাকলিতে মুখর হয়ে উঠতো পুরো এলাকা। কড়ই গাছ ও তার কুঠরে নানান পাখি বাসা বাঁধে। তারমধ্যে উল্ল্যেখযোগ্য, নানা প্রজাতির টিয়া পাখি। অনেক দুরন্ত কিশোর ভয় কে জয় করে টিয়া পাখির বাচ্চা ধরে এনে, পোষ মানিয়ে কথা ফুটায়। তার মধ্যেও অনেকেই রহস্যের গন্ধ খুঁজে পায়। এভাবেই বৃক্ষ গুলোর সাথে সেসব হারাতে বসেছে। তার সাথে পাল্লা দিয়ে হারিয়ে যাচ্ছে সোনালী অতীত-

দু’ দেশের যশোর রোডের দুধারে দৃষ্টি দিলে পার্থক্যটা সহজেই চোখে পড়ে, সীমান্তের ওপারে প্রাচীন কড়াই গাছগুলি যতটাই যত্ন ও মমতায় কালের সাক্ষ্য দিচ্ছে, অপরদিকে দেশের প্রান্তে ততটাই অযত্ন ও অবহেলায় অব্যক্ত চাপা বেদনা ও কষ্ট বুকে ধারণ করে বৃক্ষগুলো অসহায়ত্বের সাক্ষ্য দিচ্ছে।

ঐতিহাসিক সড়কটির নাম যশোর রোড হওয়ায়, স্বাধীন ছোট্ট দেশ হিসাবে গর্বিত। এই বিখ্যাত রোড নিয়ে কবি Allen Gins Berg `September on Jessore Road’ নামক একটি বিখ্যাত কবিতা রচনা করেন। কবিতাটি পরবর্তীতে গানেও রুপান্তরিত হয়েছে। গানটিতে কন্ঠ দিয়েছেন শিল্পী মৌসুমি ভৌমিক। ঐতিহাসিক বিখ্যাত নগর কলকাতা শহর হতে, পেট্রাপোল বর্ডার অবধি সড়কটির নামকরণ এখনো ‘যশোর রোড’ কিন্তু দেশের অভ্যন্তরে ভিন্ন ভিন্ন নাম। যা ভাবনার বিষয়।

ঐতিহাসিক ‘যশোর রোড’ এর মতোই, নানা খোঁড়া যুক্তিতে প্রায় বিলীন হয়েছে, এই অঞ্চলের প্রাচীন কড়ই গাছগুলি। এইতো কিছুদিন আগেও ঝিনাইদহ জেলা শহরে মূল কেন্দ্রবিন্দুতে অবস্থিত, ঐতিহাসিক কড়ই গাছ রক্ষার আন্দোলন সূচিত হয়। তা পর্যায়ক্রমে বৃহত্তর যশোর হয়ে, জাতীয় পর্যায়ের আন্দোলনে রূপ নেয়। কোথাও কোথাও পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি ও বাকবিতন্ডা চলতে থাকে, এমনকি সহিংস রূপ ধারণ করে। অনেক সমাজ উন্নয়ন ও সাংস্কৃতিক সংগঠন সমূহ নানা ভাবে প্রতিবাদ করে। বৃক্ষপ্রেমী ও পরিবেশবিদরা সোচ্চার হয়েছিলেন। কবি সাহিত্যিকগণ রচনা করেন, সংগীত-নাটক-সাহিত্য-কবিতা-গল্প। প্রকাশিত হয় প্রতিবাদী পত্রিকা বই ফেস্টুন। ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়ার কলম বৃক্ষ রক্ষায় সোচ্চার হয়েছিল। মহামান্য হাইকোর্ট সুবিবেচনার রায় প্রদান করে। তাইতো গণহারে এই বৃক্ষ নিধন বন্ধ হলেও নানা কৌশলে প্রকাশ্যে ও গোপনে বৃক্ষ ভক্ষণকারীদের পেটে, এখনও চলে যাচ্ছে ঐতিহাসিক কড়ই গাছ-

বৃক্ষ ভক্ষণকারীদের আগ্রাসনে, কোন সবুজই রক্ষা পাচ্ছে না। বদহজম হলেও, সামনে যা পায় গোগ্রাসে গিলে খায়। ফুলে ফুলে সুবাসিত, ফলাফলে ভরা ফলবতী, কোন বৃক্ষই রক্ষা পায় না। মানুষরূপী দু’পায়ের জন্তু যন্ত্রণা দানব বনে গেছে! তখন ঠুঁটো জগন্নাথ মানবদের কি বা করার আছে! কিছু বিপদগামী তরুণ প্রজন্ম প্রযুক্তিকে ব্যবহার করে, ঘরে বসে ভার্চুয়াল জগতে মানুষ মারা নিয়ম ভাঙ্গার খেলা নিয়ে ব্যস্ত, রাস্তাঘাটে অকারনে বৃক্ষের ডাল ভাঙে পাতা ছিড়ে, বিকৃত টিক টক ভিডিও তৈরি করে চলছে। তখন সচেতন মানুষ বাইরে মুখে মুখোশ ও চোখে কালো চশমা পড়ে, রাজ্য হারা বৃদ্ধ সিংহের মত পথ চলা! একসময় তরুণ বিপ্লবীরা ভূপেন হাজারিকার বিখ্যাত সব গানের কথামালা সুর তাল লয়ে উদ্বুদ্ধ হতো, কেউ কেউ গাওয়ার কসরৎ করত, কেউ ব্যর্থ হয়ে বাথরুম সিঙ্গার বনে যেত, কেউ বক্তৃতায় ব্যবহার করত। পরবর্তীতে ড. ভূপেন নীতি-আদর্শচ্যুত হলেও, ঘরে বসে বসে তার গান গাওয়া ছাড়া বৃক্ষপ্রেমী ও পরিবেশবিদদের কি বা করার আছে! ‘…মানুষ যদি সে না হয় মানুষ, দানব কখনো হয় না মানুষ, যদি দানব কখনো বা হয় মানুষ, লজ্জা কি তুমি পাবে না…ও বন্ধু’

লেখক: তারিকুল ইসলাম পলাশ

প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী  এইড ফাউন্ডেশন

 

Sharing is caring!

Related Articles

Back to top button