
করমচা সমাচার: তারিকুল ইসলাম পলাশ
একসময় গ্রামবাংলার কবিরাজ ও বনিয়াদি সনাতনী ধর্মাবলম্বীদের বাড়িতে করমচা গাছের দেখা মিলত। কি কাজে লাগে, তা অনেকেরই অজানা। প্রকৃতির বিরূপ প্রভাবেও, যে কোনো পরিবেশে বৃক্ষটি টিকে থাকতে পারে। চিরহরিৎ সুন্দর পাতা পল্লবে, সবুজের সমারোহ সুন্দর বৃক্ষটিতে চমৎকার ফুল হয়। প্রচুর ফল ধরে, এক এক সময় তার রূপ-রঙ স্বাদ গন্ধ আলাদা হয়। সঙ্গত কারণে বাড়ির আশপাশের ঝোপঝাড়ে, প্রকৃতিক ভাবে জন্মানো বৃক্ষটি, এখন শহরের টবে স্থান হয়েছে! তাইতো বামন আকৃতির করমচা গাছ হরহামেশাই দেখা মেলে! এখন শহরের শোভাবর্ধক হিসাবে গাছটি জনপ্রিয়। তাই জানা যাক করমচা সম্পর্কে কিছু কথা;
‘লেবুর পাতায় করমচা, ঝড়-বৃষ্টি ঝরে যা..’ করমচা গাছের পাতা লেবু পাতার মতো হলেও ফুল-ফলের বৈশিষ্ট্য একেবারেই ভিন্ন। করমচা টক-মিষ্টি সম্মন্বয়ে ব্যতিক্রম স্বাদের ছোট আকৃতির ফল। ইংরেজিতে, Bengal currant বা Christ’s thorn বলা হয়। Carissa গণভুক্ত কাঁটাময় গুল্মজাতীয় করমচা উদ্ভিদটি; এশিয়া, আফ্রিকা ও অস্ট্রেলিয়া মহাদেশে পাওয়া যায়। কাঁচা ফল সবুজ! আস্তে আস্তে রঙ পরিবর্তন হয়ে, পরিণত অবস্থায় ম্যাজেন্টা লাল-রং ধারণ করে। অত্যন্ত টক ও সামান্য মিষ্ট স্বাদের ফলটি খেতে খুবই চমৎকার কিন্তু পরিপক্ক না হলে বিষাদ। অনেকে না বুঝে ভুলের তিমিরেই থেকে যায়! একটু অসাবধানতায় জামের মতো জামা কাপড় নষ্ট হয়! আবার গাছটি কাঁটাযুক্ত কিছু ক্ষেত্রে বিষাক্ত! তাই দোলাচলে ফলটি খুব বেশি জনপ্রিয় হয়নি। করমচার ঝোপ দেখতে সুন্দর। কাঁটাযুক্ত গুল্মজাতীয় উদ্ভিদটি প্রাকৃতিক ভাবেই জন্মে। তবে এটা চাষও করা সম্ভব। ঝোঁপের মতো বলে গ্রামাঞ্চলে এই গাছ বাড়ির সীমানায় বেড়া হিসেবে লাগানো হয়।
করমচা ঔষধি গুণসম্পন্ন একটি ফল। ভারতবর্ষের আদি চিকিৎসা শাস্ত্র চরক’এ করমচার কথা উল্লেখ রয়েছে। ফলের পাশাপাশি করমচার অন্যান্য অংশেরও রয়েছে নানা কার্যাবলি। যেমন; করমচা গাছের পাতা সেদ্ধ জল পান করলে কালাজ্বর দ্রুত নিরাময় হয়। করমচা গাছের মূলে রয়েছে হৃদরোগ নিরাময়ে উপকারী ক্যারিসোন, বিটাস্টেরল, ট্রাইটারপিন, ক্যারিনডোনা ও লিগনাম। কাঁচা ফলের রস কৃমিনাশক হিসেবে কাজ করে।
একটু বিষাদ স্বাদ বিধায় করমচা ফল হিসেবে বেশ অবহেলিত কিন্তু পুষ্টিগুণ মোটেও অবহেলা করার মতো নয়! প্রতি ১০০ গ্রাম করমচায় রয়েছে; এনার্জি- ৬২ কিলোক্যালরি, কার্বোহাইড্রেট- ১৪ গ্রাম, প্রোটিন- ০.৫ গ্রাম, ভিটামিন এ- ৪০ আইইউ, ভিটামিন সি- ৩৮ মিলিগ্রাম, রিবোফ্লেভিন- ০.১ মিলিগ্রাম, নিয়াসিন- ০.২ মিলিগ্রাম, আয়রন- ১.৩ মিলিগ্রাম, ম্যাগনেসিয়াম- ১৬ মিলিগ্রাম, পটাশিয়াম- ২৬০ মিলিগ্রাম, কপার- ০.২ মিলিগ্রাম! করমচার নানা গুণাবলি স্বাস্থ্যরক্ষায় নানাভাবে সাহায্য করে থাকে!
ডায়াবেটিস ও হার্টের রোগীদের জন্য করমচা ফল খুব উপকারী। করমচাতে কোনো ফ্যাট বা কোলেস্টেরল নেই। তাই করমচা ওজন কমাতেও সাহায্য করে। ভিটামিন সি’তে ভরপুর করমচা খাবারে রুচি বাড়ায়। মৌসুমী সর্দি-জ্বর নিরাময়ে সাহায্য করে। স্কার্ভি, দাঁত ও মাড়ির নানা রোগ প্রতিরোধে করমচা অনন্য। করমচাতে ভিটামিন বি আছে, তাই চুলকানিসহ ত্বকের নানা রোগ প্রতিরোধে সহায়তা করে। করমচা রক্ত চলাচল স্বাভাবিক রেখে হৃদরোগের ঝুঁকি কমায়। শরীরের অভ্যন্তরীণ রক্তক্ষরণ কমাতেও করমচা কার্যকর। যকৃত ও কিডনীর রোগ প্রতিরোধে করমচা অতুলনীয়। এর পটাশিয়াম শরীরের দূষণ বহিষ্কারকরণে সহায়তা করে। করমচা কৃমিনাশক হিসেবেও কাজ করে। এছাড়া পেটের নানা অসুখ নিরাময়েও করমচা উপকারী। শরীরের ক্লান্তি ও বার বার হাই তোলা থেকে মুক্তি পাবার জন্য করমচার রস বেশ কাজে দেয়। বাতরোগ ও ব্যথাজনিত জ্বর নিরাময়ে করমচা খুব উপকারী। করমচাতে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন এ, যা চোখের জন্য খুবই দরাকারী। করমচার কার্বোহাইড্রেট কর্মক্ষমতা বৃদ্ধি করে, আরো কত কি..! এর গুণ বলে শেষ করা দুরহ! তাই সেই চেষ্টায় না যাই-
করমচার চমৎকার আচার হয়। যার স্বাদ ও পুষ্টিগুণ অতুলনীয় কিন্তু অধিকাংশ মানুষ এর টক-মিষ্টি অচেনা স্বাদের কারণে ফলটি এড়িয়ে চলেন। যা এখন শুধু শহুরে শৌখিনতায় আবদ্ধ হয়ে গেছে। তাই গাছটি প্রকৃতি হতে, প্রায় বিলুপ্ত প্রজাতির তালিকায় স্থান হয়েছে! এই মহামূল্যবান ঔষধি বৃক্ষটির স্বরূপে রক্ষা করি।
লেখক: তারিকুল ইসলাম পলাশ
প্রতিষ্ঠাতা ও নির্বাহী প্রধান এইড বাংলাদেশ