করোনা: শত্রুর সাথে বসবাসের ১৫ মাস-আবু নাসের অনিক

 

দেশ করোনা সংক্রমণের ১৫ মাস পার করেছে। সংক্রমণের বিস্তার, মৃত্যু ক্রমশই বাড়ছে। পূর্বে সংক্রমণ ছিল শহরাঞ্চলে। এখন ছড়িয়ে পড়ছে প্রত্যন্ত গ্রামে। অবশ্য এমনটি যে হবে সেটি পূর্বেই ধারণা করা যাচ্ছিল সরকারের অবৈজ্ঞানিক প্রসূত কৌশলের বিবেচনায়।

ঈদের পূর্বে মার্কেট খুলে দেওয়া, হুড়াহুড়ি করে মানুষের গ্রামে যাওয়া-ফিরে আসা, সময়মত ভারতের সীমান্তগুলি বন্ধ না করা, স্থল সীমান্ত বন্ধ করার পরেও আবার আকাশ পথ খুলে দেওয়া, এই সব কিছু মিলিয়ে বর্তমান পরিস্থিতি। সীমান্ত বন্ধ করার পরেও যারা বিশেষ বিবেচনায় ভারত থেকে দেশে ফিরেছে তাদের প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টাইন ব্যবস্থাপনায় দূর্বলতা লক্ষণীয়। এমনকি হাসপাতাল থেকে পালিয়ে যাবার মত ঘটনা ঘটেছে একাধিকবার। টেস্টের সংখ্যাও অপ্রতুল।

অবৈধভাবে সীমান্ত পেরিয়ে যারা দেশে ঢুকেছে এবং এখনও ঢুকছে তাদের প্রবেশ ঠেকানো সম্ভব হচ্ছে না। এদের মধ্যে একটি বড় অংশ সংক্রমিত। কিন্তু চিহ্নিত করতে না পারার কারণে সংক্রমণ বিস্তার ঘটছে এই অংশের মাধ্যমেও। কন্ট্রাক্ট ট্রেসিং এর কোন অস্তিত্ব নেই। অথচ কয়েক লক্ষ টাকা ব্যয়ে অ্যাপস বানানো হলেও এর ব্যবহারিক কোন কার্যকারিতা নেই।

যারা বলেছিলেন, গ্রামের নির্মল প্রাকৃতিক খোলামেলা পরিবেশ, মানুষের কায়িক শ্রমের কারণে গ্রামে করোনা সংক্রমণ হচ্ছে না, সংক্রমণের বর্তমান পরিস্থিতি তাদের এই ভাবনার সাথে আর মিলছে না। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দক্ষিণপূর্ব এশিয়া অঞ্চলের সাবেক উপদেষ্টা অধ্যাপক ডা. মোজাহেরুল হক বলেন,‘আমরা আগে দেখেছি গ্রামে করোনার সংক্রমণ ছিল না। এবার দেখা যাচ্ছে গ্রামের মানুষ করোনায় আক্রান্ত হচ্ছে’।

রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নাটোর, দিনাজপুর, জয়পুরহাট, ঠাকুরগাঁ, নওগাঁ,রংপুর, কুষ্টিয়া, যশোর, ঝিনাইদহ, নড়াইল, মাগুরা, চুয়াডাঙ্গা, মেহেরপুর, সাতক্ষীরা, খুলনা, বাগেরহাট, গোপালগঞ্জ, শেরপুর, টাঙ্গাইল, নোয়াখালি, পিরোজপুর, বরিশাল, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার এর প্রত্যন্ত গ্রামে করোনা সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়েছে। এ সমস্ত জেলায় সংক্রমণের হার ৭৫%-২৫% এর ঘরে(স্বাস্থ্য অধিদপ্তর)। কায়িক পরিশ্রম আর প্রাকৃতিক পরিবেশ কোন কিছুই সংক্রমণের বাধা হয়ে দাড়াঁতে পারছে না।

গ্রামগুলিতে আক্রান্তরা পরীক্ষা করাতে চাচ্ছে না। তার কারণে সংক্রমণ আরো বেশি অনিয়ন্ত্রিত হয়ে পড়ছে। প্রতিদিনই করোনা উপসর্গ নিয়ে মানুষের মৃত্যু ঘটছে। সাতক্ষীরার সিভিল সার্জন বলেন,‘বিশেষকরে সীমান্তবর্তী এলাকার মানুষ বেশি অসচেতন। কেউ নমুনা পরীক্ষা করাতে চায় না। সেজন্য এখন গ্রামের বাড়িতে বাড়িতে করোনা ছড়িয়ে গেছে বলে আমাদের মনে হচ্ছে। এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ খুব কঠিন হবে আমাদের জন্য’। চট্টগ্রামের সিভিল সার্জন বলেন,‘বর্তমানে গ্রামাঞ্চলে সংক্রমণ বৃদ্ধি পাচ্ছে। এখন নগরীতে ৬০ শতাংশ আর গ্রামে ৪০ শতাংশ। অর্থাৎ গ্রামে সংক্রমণ আগের চেয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে’।

করোনা নিয়ন্ত্রণে পুরো ব্যবস্থাপনাটি হ-য-ব-র-ল অবস্থা। এ ধরনের ব্যবস্থাপনার কারণে দেশে করোনা সংক্রমণ কখনও নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব নয়। স্মরণ করুন, প্রায় এক বছর পূর্বে ১৮ জুন,২০২০ স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তৎকালীন ডিজি ডা. আবুল কালাম আজাদ বলেছিলেন,‘দেশের করোনাভাইরাস আগামী এক-দুই বা তিন মাসে যাবে না। এটি দুই থেকে তিন বছর বা তার চেয়েও বেশি স্থায়ী হবে’। তিনি সেদিন সরকারের করোনা সংক্রমণ পরিস্থিতি মোকাবেলার বাস্তবতা বিবেচনায় এ ধরনের বক্তব্য দিয়েছিলেন।

তাঁর এই বক্তব্যে সরকারের মন্ত্রী, উর্ধ্বতন কর্মকর্তা, রাজনৈতিক নেতা সবাই ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন। এমনকি একদিন পর তাকে দুঃখ প্রকাশ করে বিবৃতি দিতে হয়। ইতিমধ্যে সংক্রমণের ১৫ মাস পার হয়ে গেছে। যা তাঁর সেদিনের বক্তব্যের সঠিকতায় প্রমাণ করছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ডিজি হিসাবে তিনি জানতেন, যে প্রক্রিয়ায় সরকার এগোচ্ছে তাতে এই সংক্রমণ ১-২ বছরে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে না। প্রকৃত অর্থে সরকার মুখে যা বলে বাস্তবে কাজের সাথে কোন সামঞ্জস্যতা পাওয়া যায় না।

ভারতে যখন সংক্রমণ লাগাম ছাড়া অবস্থায় পৌঁছেছে, তার আগে থেকেই আশঙ্কা প্রকাশ করা হয় পার্শ্ববর্তী দেশ হিসাবে এর প্রভাব আমাদের দেশেও পড়বে। পড়েছেও তাই! এতো সর্তকবাণী উচ্চারনের পরেও আন্তর্জাতিক হেলথ রেগুলেশন অনুযায়ী, সীমান্তে যেসব ব্যবস্থা নেওয়ার কথা ছিল সরকার তা নেয়নি।

অথচ ২০১৭ সাল থেকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের আওতায় আন্তর্জাতিক বন্দরগুলোতে স্বাস্থ্য সুরক্ষা জোরদার ও প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য একটি কর্মসূচি চালু আছে। কিন্তু সীমান্তের বন্দরগুলোতে প্রতিবেশি দেশ থেকে আসা ব্যক্তিদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা ও চিকিৎসাসেবা দেওয়ার স্থায়ী কোন উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়নি।

এক বছর আগে এডিবি’র অর্থায়নে ‘কোভিড-১৯ রেসপন্স ইমার্জেন্সি অ্যাসিস্ট্যান্স’ প্রকল্পের আওতায় ২৬ টি স্থল বন্দরে মেডিকেল স্ক্রীনিং সেন্টার স্থাপনের কথা। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর অদ্যাবধি এই প্রকল্পের কাজ শুরুই করতে পারেনি। বিশ্ব ব্যাংকের সহায়তায় ‘কোভিড-১৯ ইমার্জেন্সি রেসপন্স অ্যান্ড পেনডেমিক প্রিপায়র্ডনেস’ প্রকল্পের আওতায় ৩ টি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ৭ টি স্ক্রীনিং সেন্টার নির্মাণের কথা। এক বছর পার হলেও স্বাস্থ্য অধিদপ্তর অদ্যাবধি এই প্রকল্পেরও কাজ শুরু করতে পারেনি। বরাদ্দকৃত ৩ কোটি ৪০ লাখ টাকা অব্যবহারিত অবস্থায় পড়ে রয়েছে।

জনস্বাস্থ্যবিদ অধ্যাপক ডা. বে-নজির আহমেদ বলেন,‘আমরা জানি স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও মন্ত্রণালয় টাকা খরচ করতে দক্ষ নয়। কিন্তু জরুরি কিছু কাজ তারা করবে না, এটা ভাবা যায় না। মহামারির সময়ে আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্য রেগুলেশন বাস্তবায়নে তারা মনযোগী হলে সীমান্তে সংক্রমণ হয়তো নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব হতো’।

গত ২ মাস আগে থেকে বলা হচ্ছে, করোনা রোগীদের চিকিৎসা দেবার জন্য জেলা হাসপাতাল ও উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্র প্রস্তুত রাখা হয়েছে। বাস্তবতা হচ্ছে, ইতিমধ্যে হাসপাতালের মেঝেতে রেখেও জায়গার সংকুলান করা যাচ্ছে না। অক্সিজেন, আইসিইউ সংকট প্রকট আকার ধারন করেছে।

জেলা শহরে লকডাউন দিলেও সেটি কার্যকর হচ্ছে না। কারণ লকডাউন কার্যকর করার জন্য যে সকল প্রস্তুতি গ্রহণের প্রয়োজনীয়তা থাকে সেগুলি যথারীতি নিয়মে সম্পন্ন করেনি। জনসম্পৃক্ততা নেই। এটি কার্যকর না হলে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে আনাও সম্ভব নয়। এসবের মধ্যে টিকা নিয়ে চরম অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। আবারও টেস্টের ভুয়া রিপোর্ট বাণিজ্য হচ্ছে। মজার বিষয় ভুয়া রিপোর্ট স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ওয়েব সাইটে আপলোডও হচ্ছে। সাবরিনা, শাহেদ কান্ড ঘটার পরেও একই ঘটনা ঘটে চলছে, কারণ সাবরিনাদের পেছনে থাকা ব্যক্তিরা চিরাচরিত নিয়মে আইনের আওতায় আসেনি। সুতরাং আগামীতেও একই ঘটনা ঘটতে থাকবে, এত বিস্মিত হবার কিছু নেই!!

দেশে সার্বিকভাবে আইনের শাসন অনুপস্থিত। সরকার নিজে আইন মানে না, সেটার প্রভাবে জনগণও আইন মানে না। বাংলাদেশে বর্তমানে মহামারি পরিস্থিতি বিদ্যমান। সে অনুসারে সংক্রামক রোগ(প্রতিরোধ, নিয়ন্ত্রণ ও নির্মূল) আইন, ২০১৮ বলবৎ। অথচ সরকার নিজেই এই আইন মানে না। সরকার যে সকল সিদ্ধান্ত গ্রহণ করছে তা এই আইনের সাথে স্পষ্টতই সাংঘর্ষিক।

করোনা সংক্রমণের এ ধরনের পরিস্থিতির মধ্যেই নির্বাচন কমিশন ২১ জুন পিরোপুর জেলায় ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন করার সিদ্ধান্তে অনড়। যেখানে এই মুহুর্তে সংক্রমণের হার ৭৫%। নির্বাচন কমিশন আইনের বাধ্যবাধকতার বিষয়টি সামনে আনছে। অথচ সংক্রামক আইনের (৩) ধারায় বলা হচ্ছে,‘আপতত বলবৎ অন্য কোন আইনে যাহা কিছুই থাকুক না কেন, এই আইনের বিধানাবলি প্রাধান্য পাইবে’। অর্থাৎ দেশে সংক্রামক রোগ আইন, ২০১৮ এটি না মানছে সরকার, না নিবার্চন কমিশন, না জনগণ!! না, মানার জয়জয়কার অবস্থা!

সেক্ষেত্রে দেশে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে আসার কোন বাস্তবতায় তৈরি হচ্ছে না। লকডাউন ঘোষণা খাতা-কলমে থাকলেও একমাত্র শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছাড়া সবকিছুই স্বাভাবিক সময়ের মতই চলছে। এভাবে বছরে পর বছর পার হলেও বাংলাদেশে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে আসা দুই-চার বছরের মধ্যেও সম্ভব হবে না।
লেখক: আবু নাসের অনিক

সাবেক সভাপতি-বিপ্লবী ছাত্র মৈত্রী।

Sharing is caring!

Related Articles

Back to top button