
বঙ্গোপসাগরের তীরে ঘোড়ার মৃত্যু কিসের অশনিসংকেত: মনির ইউসুফ
কি লিখবো, কেন লিখবো, কার জন্য লিখবো! অন্ধ হলে যে প্রলয় বন্ধ হয় না, শুনেছি। যারা চোখ থাকতেও অন্ধ তাদের চোখ থেকেও কি লাভ! ঘোড়া এমন এক প্রাণি যার বদৌলতে বদলে গিয়েছিল পৃথিবী। বদলে গিয়েছিল গুহা থেকে বের হয়ে মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়ানো মানুষের পৃথিবী। ঘোড়া পৃথিবীর বুকে গতির এমন এক ঝড় তুলেছিল আজ পর্যন্ত জগতের শক্তিকে (পাওয়ার) মাপা হয় ঘোড়ার সেই গতি দিয়ে। ঘোড়া নিয়ে লেখা হয়েছে কত কবিতা, গান, উপন্যাস। বারুদ ও গাড়ি আবিষ্কারের আগে মানবজাতিকে এগিয়ে দিয়েছে এই ঘোড়া। ঘোড়া না থাকার কারণে বৈদিক যুগের পূর্বে যে ভারত ছিল তা তছনছ করে আর্যরা ভারত দখল করে নিয়েছিল। বলতে পারি বৈদিক যুগের পূর্বের ভারতীয়রা ঘোড়ার জন্যই আর্যদের কাছে পরাজিত হয়েছিল৷ আমি ঘোড়ার শক্তির সে কথাউপকথা গল্পের কথা বলবো না আজ। আমি আজকে বলবো আমাদের অসভ্যতা ও বর্বরতার কথা। কক্সবাজারে সমুদ্র সৈকতে লোভী বণিকরা ঘোড়া নিয়ে এসেছিল, তাদের বাণিজ্যকে আরও বেশি সম্প্রসারিত করতে। ঘোড়াকে বিনোদন বাণিজ্যের মধ্যদিয়ে আরও বেশি মুদ্রা ইনকাম করতে। করে ছিল না, এমন নয়। কোভিড মহামারির আগে সরকার লকডাউন দেওয়ার পূর্বে ঘোড়ার বাণিজ্যিক কদর ছিল শনৈ শনৈ। তারপর এল অটোগাড়ি। সমুদ্রের বুকে নামলো রোলার কোষ্টার। আমার বুক চিরে ফেলার মত প্রতিদিন সমুদ্রের বেলাভূমি চিরে ফেলা হলো। বর্বরেরা পুরুষ-নারী মিলে অটোগাড়িগুলোতে পশু পশু মুখ নিয়ে নিজেদের পশুত্বকে উদযাপন করতে লাগলো। এরা যে এনিমল সেটা বুঝার মত জ্ঞান বিবেকও এদের নেই। বুর্জোয়া উন্নয়ন নিয়ে এরা ঝাঁপিয়ে পড়লো সমুদ্র তীরে, বেলাভূমিতে। এরা তীর দখল করলো, সমুদ্র তট দখল করলো, সামন্য বেলাভূমি আমি বলি পৃথিবীর বারান্দা তাকেও গুতিয়ে-খুঁচিয়ে রক্তাক্ত করলো। এদের বাণিজ্যের খায়েশ তবুও মেটে না। সমুদ্রের বালি এদের অত্যাচারে পিশে যেতে যেতে মিইয়ে গেল। আমি যেমন অসহায়, সমুদ্রও অসহায়, অসহায় সমুদ্র চরও। এসব অসভ্যতা কারা করছে সেটা দিনের মত স্পষ্ট। আমি কি সাহস করে বলতে পারি না, আজকে যারা ক্ষমতায়, আজকে যারা শাসক শ্রেণি, যাদেরকে প্রতিদিন আমরা পূজা দিচ্ছি, সালাম দিচ্ছি তারা। পৃথিবীব্যাপি সহিংস উন্নয়ন ছড়িয়ে দেওয়া কর্পোরেট বেশ্যাদের দালাল এরা। কক্সবাজার সমুদ্র তীরে অটোগাড়ি নামাবে কেন? এ প্রশ্ন আমার মত বোকা মানুষ করতে পারে। কিন্তু তাদের মত চালাক মানুষেরা অটোগাড়ি নামাবেই। এর নাম আধুনিকতা, এর নাম উন্ময়ন। এরা মেয়র, কাউন্সিলর, ডিসি-মিসি। এরা রাজনৈতিক ক্ষমতার মদমত্ত পাগল টুপাইস কামানোর কর্পোরেট চোখে পৃথিবী দেখা পশুমানব। এরা আবার সমাজের রাষ্ট্রের কুতুব। তাদের বিরুদ্ধে কিছু বলা মানে নিজের পায়ে নিজে কুড়াল মারা। বন্ধু, আমি অসহায়। ছোটভাই অন্তিক চক্রবর্তী, সমুদ্র শহরে মরে যাওয়া ঘোড়া নিয়ে লেখার জন্য আমাকে ইঙ্গিত করেছে, সরাসরি বলে নাই, তবুও ভালো সে নিজেও লিখেছে, আমাকেও লিখতে উৎসাহিত করেছে। ভাই, এই বুর্জোয়া চোখের আয়নায় পৃথিবীতে তুমি আমি পাগল। তুমি সুন্দরের কথা বলো, তুমি রেনেসাঁসের স্বপ্ন দেখো, তুমি বিপ্লব চাও, তাই নগদ দুটাকা লাভের পৃথিবীতে তুমি আমি কত বোকা। সমুদ্র চরে অটোগাড়ি নামালো আমরা কেউ প্রতিবাদ করিনি, সমুদ্রের বুক ফালা ফালা করে ফেলা হলো, ঝাউগাছ কেটে ফেলা হলো, একটি সরকারি বাহিনি সরকারের অনুমতি নিয়ে ঝাউগাছ কেটে বিল্ডিং তোলা শুরু করলো, সামরিক বাহিনীর গেস্ট হাউজ সাগরের বুকে। বন্ধু অন্তিক এসব প্রশ্ন আমাদের তুলতে হবে। সমুদ্র শহরকে যদি বাঁচাতে চাই, তাহলে সাম্রাজ্যের এসব লোভের লালা থেকে আমরা কক্সবাজার বাঁচাবো কি করে? যেখানে আমাদের রক্ত, আমাদের পাড়া প্রতিবেশিরা কর্পোরেটের দালাল হয়ে পড়েছে।
তাই এখন লিখতে গেলে আমার নিজের বিরুদ্ধে লিখতে হবে। আমার বাবা, ভাই, পাড়া প্রতিবেশির বিরুদ্ধে। কক্সবাজারের সামান্য স্থলভূমি সরকারি বেসরকারি ব্যক্তি মিলে দখল করে নিয়েছে। দেশের সব গ্রুপ আব কোম্পানি, সব বাহিনি, সব সরকারি ডিপার্টমেন্ট, বিশ্ববিদ্যালয়, তারা নিজেরা মউজ করার জন্য, কক্সবাজারে ফ্রি থাকার জন্য রেস্ট হাউস, গেস্ট হাউস ইত্যাদি করে ফেলেছে। দেশবিদেশের সব টাকাওয়ালার কক্সবাজারে একখণ্ড জমি দরকার। তাই তারা দরকার মত নিয়ে নিয়েছে। ভারতীয় টাটা, এনজিওগুলো, জাতিসংঘ সব একটু একটু করে দখল নিয়েছে এর জমি। তো সেখানে ঘোড়া মরবে, তিমি মরবে, মরবে ডলপিন, হাঙর। মরবে মানুষ। মরবে তার পরিবেশও।
এইসব ষড়যন্ত্র ভেঙে তোমাকে আমাকে দাঁড়াতে হবে। দ্য গড অব স্মল থিংসদের এসব ছোট ছোট লোভী দেবতাদের হত্যা করতে হবে। তা কিভাবে সম্ভব! এ খুব কঠিন কাজ যার জন্য নিজের গর্দানও চলে যেতে পারে। ছোট ভাইটি আমার, মাতৃভূমি রক্ষার জন্য তুমি-আমি কি প্রস্তুত! ভূমিপুত্ররা সজাগ না হলে, সচেতন না হলে, নিজ ভূখণ্ডে আমাদের পরবাসী হয়ে থাকতে হবে। আমরা কি এখন পরবাসীর মত নই। যে ভূখণ্ডের উন্নয়নে, যে ভূখন্ডের বিক্রিতে যেখানে আমাদের মতামতের কোন দাম নেই, সেখানে আমরা কি এখানের জনগণ না দাস? এ প্রশ্ন আমরা করতেই পারি।
এই মহান বুর্জোয়া উন্নয়ন, একচেটিয়া, সহিংস উন্নয়ন, সেখানে ঘোড়া মরবে। যারা ঘোড়া লালনপালন করেছে এটা তাদের চরম অবহেলা। যদি প্রকৃতই এরা ঘোড়াপ্রেমি হতো তাহলে এগুলো মরত না। যেভাবে হোক এগুলো বাঁচিয়ে রাখতো। কয়েকটা ঘোড়ার মৃত্যুর মধ্যদিয়ে এরা প্রশাসনের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। এই ঘোড়াবাবদ সরকার থেকে দানঅনুদান নেবে। আমরা আফসোস করতে পারি ঘোড়ার জন্য, আহা, ঘোড়াজীবন। এগুলো পরিকল্পিত মৃত্যু, খুন। আমরা এই খুনীদের বিচার চাই। যেমন বিচার চাই, সমুদ্র চরে যারা অটোগাড়ি নামিয়ে প্রকৃতি ধ্বংস করেছে তাদেরও।
লেখক: মুনির ইউসুফ, সম্পাদক-কবিতার রাজপথ, সমন্বয়ক-বিপ্লবী লেখক আন্দোলন