
মেঘনা নদী গিলে খাচ্ছে মেঘনা গ্রুপ!
শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে গিয়ে মেঘনা গ্রুপের সাতটি প্রতিষ্ঠান প্রবহমান মেঘনা নদীর ২৪১.২৭ একর জমি অবৈধ দখল করে নিয়েছে। এর মধ্যে ৮৪.৭৭ একর নদীর জমিতে মূল ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। আবার ৫.৫ একর জমিতে নির্মাণ করেছে নিজস্ব রাস্তা। অবৈধভাবে দখল করা এসব জমি এক মাসের মধ্যে উদ্ধার করে নদীর প্রবাহ ফিরিয়ে আনার জন্য নারায়ণগঞ্জের জেলা প্রশাসক, বিআইডাব্লিউটিএ ও পানি উন্নয়ন বোর্ডকে নির্দেশ দিয়েছে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন। এ ছাড়া নদী রক্ষায় ব্যর্থ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়ারও সুপারিশ করেছে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন।
কমিশনের প্রতিবেদন প্রকাশ্যে আসার পর তোলপাড় শুরু হয়েছে। নড়েচড়ে বসেছে প্রশাসনও। একই সঙ্গে সবখানে আলোচনা চলছে মেঘনা গ্রুপের নদী দখলের প্রসঙ্গ। বছরের পর বছর প্রভাব খাটিয়ে এবং মিডিয়া ব্যবহার করে মেঘনা গ্রুপ যেভাবে নদী গিলে ফেলেছে তার চিত্র ফুটে উঠেছে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের প্রতিবেদনে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের সার্বক্ষণিক সদস্য ও তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক মো. আলাউদ্দিন বলেন, ‘তদন্ত প্রতিবেদন মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ ও নারায়ণগঞ্জের জেলা প্রশাসককে দেওয়া হয়েছে। সেই আলোকে প্রশাসনের দায়িত্বপ্রাপ্ত হিসেবে জেলা প্রশাসক নদীর জমি উদ্ধারে ব্যবস্থা নেবেন। তবে এখনো আমার হাতে তদন্ত প্রতিবেদন আসেনি।’
মেঘনা নদীর এমন জমি, যা আরএস পরচায় ব্যক্তিমালিকানায় মেঘনা গ্রুপ অবৈধভাবে দখল করে নিয়েছে। ওই সব বন্দোবস্তবহির্ভূত জমিতে অবিলম্বে উচ্ছেদ ও উদ্ধার কার্যক্রমের ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করা হয়েছে তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে। জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের গঠিত ১২ সদস্যের তদন্ত কমিটি দীর্ঘ দুই বছর সরেজমিনে তদন্ত করে একটি প্রতিবেদন গত ১৪ জানুয়ারি মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে জমা দিয়েছে।
জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান ড. মজিবুর রহমান হাওলাদার স্বাক্ষরিত তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, নারায়গঞ্জ জেলার সোনারগাঁ উপজেলা এলাকায় মেঘনা গ্রুপ কর্তৃক প্রবহমান মেঘনা নদী দখলের বিষয়ে সরেজমিন তদন্ত প্রতিবেদন পেশ করার জন্য ১২ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির সব সদস্য তদন্ত কার্যক্রম শুরু করেন; কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত ২০২০ সালের মার্চ মাস থেকে করোনার প্রাদুর্ভাবের কারণে কমিটির তদন্ত কার্যক্রম কিছুটা ঝিমিয়ে পড়ে। পরে আবারও কার্যক্রম শুরু করে তদন্ত কমিটি। তদন্ত কমিটিকে চার কার্যবিধি নির্ধারণ করে দেওয়া হয়। তদন্ত কমিটি গঠনের পর ২০১৯ সালের ২০ অক্টোবর জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের অফিসে কমিটির প্রথম প্রস্তুতি সভা অনুষ্ঠিত হয়।
সভায় বলা হয়, নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁ উপজেলার বৈদ্যের বাজার ইউনিয়ন, হোসেনপুর ইউনিয়ন ও পিরোজপুর ইউনিয়নের চর রমজান, সোনাউল্লাহ, পূর্ব দামেদরদী, পশ্চিম দামেদরদী, দুধঘাটা টেঙ্গরচর, ছয়হিস্যা, নরসুলদী, আষাঢ়িয়ারচর এবং ঝাউচর এলাকায় মেঘনা গ্রুপ মেঘনা নদীর জমি ভরাট করে সাতটি শিল্পপ্রতিষ্ঠান স্থাপন করেছে। নদীর তীর ঘেঁষে মেঘনা গ্রুপ শিল্প বা ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছে, যা সোনারগাঁ উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) সভায় কমিটিকে অবহিত করেন। এ ছাড়া কমিটির তদন্ত কার্যক্রম পরিচালনা পদ্ধতি বিষয়ে সভায় একমত প্রকাশ করা হয়।
তদন্ত কার্যক্রমে বলা হয় : ২০১৯ সালের ২৪ অক্টোবর তদন্ত কমিটি সোনারগাঁ উপজেলার মেঘনা নদীর বিভিন্ন এলাকা পরিদর্শন করে। উপজেলার ঝাউচর এলাকায় মেঘনা পাল্প ও পেপার মিলস, মেঘনা নদীর মূল ভূমিতে স্থাপিত মেঘনা গ্রুপের শিল্প-কারখানা, মেঘনা গ্রুপের সুগার রিফাইনারি কারখানা, মেঘনা সুগার মিল কর্তৃক দূষণ, মেঘনা ফ্রেশ টি কর্তৃক দূষণ, কেমিক্যাল ফ্যাক্টরি, ফ্রেশ সিমেন্ট, দুধঘাটায় বালু ভরাটকরণ, মেঘনা নদীর রান্দীর খাল এলাকায় অবৈধভাবে দখল করে এসব প্রতিষ্ঠান করা হয়েছে। গত বছরের ৯ ডিসেম্বর কমিশনের চেয়ারম্যান আবারও মেঘনা নদী ও এর শাখা নদীগুলো পরিদর্শন করেন। পরে গত বছরের ১২ ডিসেম্বর আবারও ক্রয়সংক্রান্ত কমিটির সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় আ জ ম জাহেদুল ইসলাম প্রাথমিক তথ্যের আলোকে ডিজিটাইজ করে মেঘনা নদীর সীমানা সিএস ও আরএস নকশার ভিত্তিতে নদীর সীমানা পরিবর্তনের তুলনামূলক চিত্র সভায় উপস্থাপন করেন। পরে মেঘনা গ্রুপের সঙ্গে আলোচনাসভা করে তদন্ত কমিটি।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের পাশে মেঘনার শাখা নদী মারাখালী নদীর অংশের উত্তর ও দক্ষিণ অংশের পার থেকে নদীর ভেতরে প্রায় দুই কিলোমিটার পর্যন্ত দখল করার অভিযোগ উঠেছে। মেঘনা নদীর অন্তত ৩০০ বিঘা জমি দখল করেছে মেঘনা গ্রুপ। দখলকৃত স্থানে এরই মধ্যে গড়ে তোলা হয়েছে মেঘনা গ্রুপের মালিকানাধীন ফ্রেশ টি, ফ্রেশ সুগার মিলস, পেপার মিলস, কেমিক্যাল ফ্যাক্টরিসহ বিভিন্ন ধরনের প্রতিষ্ঠান। ভূমিদস্যুতার এই প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে নেই মেঘনার পারিবারিক প্রতিষ্ঠানগুলোও। গ্রুপের ভাগ্নিজামাই বলে পরিচিত আল মোস্তফার ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান গ্রুপও নদী দখল করে ব্যাগের কারখানা গড়ে তুলেছে। ২০১০ সাল থেকে ধাপে ধাপে এবং একটু একটু করে এসব জমি দখল করে নেওয়া হয়। মেঘনা গ্রুপের এমন অবৈধ দখলে ভরাট হওয়ায় সাধারণ গতিপথ হারাতে বসেছে প্রবহমান মেঘনা। নদী ডাকাতির এক কর্মকাণ্ডে অস্তিত্ব সংকটের হুমকিতে আছে আশপাশের নদীসংলগ্ন বিভিন্ন নিচু এলাকা ও চরের জমিগুলো। মেঘনা গ্রুপ আনন্দ বাজার এলাকায় মেঘনা নদীর প্রায় ৫০০ ফুট জায়গা দখল করে মাটি ভরাট করেছে এবং প্রায় ৫০ একর জমি। ফিরোজপুর ইউনিয়নের ছয়হিস্যা জৈনপুরসহ বিভিন্ন এলাকায় ১০০ বিঘা জমি গ্রাস করেছে। আষাঢ়িয়ারচর ও ঝাউচর এলাকায় নদীর বেশির ভাগ ভরাট করেছে। নদীর প্রায় ৭০০ ফুট দখল করে সীমানাপ্রাচীর নির্মাণ করেছে মেঘনা গ্রুপ। হাড়িয়া এলাকায় মেঘনা নদীতে অবৈধ স্থাপনা ও জেটি নির্মাণ করে দখল করেছে। মেঘনা নদীর শাখা সরকারি রান্দীর খালে প্রায় দুই কিলোমিটার বালু দিয়ে ভরাটসহ নদীর প্রায় এক হাজার ৫০০ বিঘা জমি ভরাট করে চারদিকে সীমানাপ্রাচীর নির্মাণের কাজ চলছে। এ ছাড়া ছয়হিস্যা ও দুধঘাটা এলাকায় ভরাট করে শিল্পপ্রতিষ্ঠান নির্মাণের কাজ চলছে বলে তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। নদী দখল করে নিজের সাম্রাজ্য গড়ার এই মহাযজ্ঞে মেঘনা গ্রুপ সরকারি প্রশাসনের কিছু অসাধু কর্মকর্তা ও কর্মচারীর সহযোগিতা পাচ্ছে। পরিবেশ অধিদপ্তরের নারায়গঞ্জ জেলা কার্যালয়, বিআইডাব্লিউটিএ কার্যালয়, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কার্যালয় ও উপজেলা সহকারী কমিশনারের (ভূমি) কার্যালয়ের একাধিক কর্মকর্তা ও কর্মচারীর সঙ্গে মেঘনা গ্রুপের গভীর সম্পর্ক রয়েছে, যা মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের নির্দেশনার ফলে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন এই তদন্ত কমিটি গঠন করে। সেই প্রতিবেদনে এসব তথ্য রয়েছে।
মূল ভবন নির্মাণ : নারায়গঞ্জের সোনারগাঁ এলাকায় মেঘনা গ্রুপের বিভিন্ন শিল্পপ্রতিষ্ঠান রয়েছে। মেঘনা গ্রুপের দাবি অনুযায়ী তাদের ১৬টি প্রতিষ্ঠানের নামে জমি ক্রয় করা হয়েছে; যার সাতটি প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম চলমান। মেঘনা গ্রুপ জমি ক্রয় করেছে ১১০.৪৩ শতাংশ। এর মধ্যে ৬৬.২৩ একর নদীতে বিলীন হয়েছে। তবে শুনানির সময় কাগজপত্রে ৯২.৮২ একরের তথ্য পেয়েছে তদন্ত কমিটি। ১৬টি প্রতিষ্ঠানের নামে জমি ক্রয় করা হয়েছে। এই প্রতিষ্ঠান রয়েছে ইটিপিতে। জেটিতে রয়েছে তিনটি প্রতিষ্ঠান। জেটির জন্য বিআইডাব্লিউটিএ থেকে অনুমতি দেওয়া হয়েছে। তবে তিনটি প্রতিষ্ঠান নদীর জমিতে করা হয়েছে। নদীর সঙ্গে লাগোয়া, তা সত্ত্বেও প্লাবনভূমিতে ফোরশোর ও পোর্টলিমিট বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড ও বিআইডাব্লিউটিএ নির্ধারিত হয়নি। বিআইডাব্লিউটিএ থেকে বলা হয়েছে, জেটি দুটি নদীর জমিতে স্থাপন করার কারণে লাইসেন্স নবায়ন করা হয়নি।
ভূমি অফিসের বক্তব্যে বলা হয়, সিএস রেকর্ড অনুযায়ী মেঘনা গ্রুপের সব জমি নদীর জমি। এখানে আরএস অনুযায়ী ১.৮৬ একর খাসজমি বিভিন্ন ব্যক্তিকে বন্দোবস্ত প্রদান করা হয়। সরকারের কাছ থেকে বন্দোবস্ত গ্রহণকৃত জমি অন্যের কাছে বিক্রয়ের ক্ষেত্রে সরকারের অকৃষি খাসজমি বন্দোবস্ত নীতিমালা অনুযায়ী সরকারকে বিক্রয় মূল্যের ২৫ শতাংশ অর্থ ক্ষতিপূরণ হিসেবে দিতে হয়। তা ১.৮৬ একর জমি বিক্রয়ের ক্ষেত্রে এই নীতি লঙ্ঘিত হয়েছে।
আইনগত পর্যালোচনা : সিএসভুক্ত নদীর জমি আইনসিদ্ধ কোনো পদ্ধতিতে অন্যরূপ কিছু না হলে তা নদীর জমি হিসেবেই বিবেচিত হবে। প্রচলিত আইন অনুযায়ী এবং উচ্চ আদালতের নির্দেশনার আলোকে নদীর জমিতে কোনো অবকাঠামো তৈরি করে ব্যবহার করার কোনো সুযোগ নেই। মেঘনা গ্রুপের বেশির ভাগ ভবন নদীর মধ্যে এক বা একাধিক জেটি নির্মাণ করে ব্যবহার করা হচ্ছে। পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে মেঘনা গ্রুপের সাতটি প্রতিষ্ঠানের নামে ছাড়পত্র দেওয়া হয়েছে, যা নদীর জমিতে কিংবা প্লাবনভূমিতে স্থাপিত শিল্পপ্রতিষ্ঠান পরিবেশের জন্য বিশাল হুমকি। তরল বর্জ্য নদীর পানিতে ফেলেও পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের জন্য বিপজ্জনক পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে।
সুপারিশ : মেঘনা গ্রুপের জমি উদ্ধারের লক্ষ্যে কমিটি ১২টি সুপারিশ করেছে। এতে দ্রুত সময়ের মধ্যে নদীর জমি উদ্ধারের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, কমিশনের সুপারিশ মোতাবেক দ্রুত ব্যবস্থা নিতে না পারলে দখলদারদের কবল থেকে নদী উদ্ধার করা কঠিন হয়ে পড়বে। মেঘনার ক্ষেত্রে এটি আরো কঠিন হবে। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, মেঘনা গ্রুপের দখলে থাকা নদীর জায়গা দখলমুক্ত করতে একাধিকবার অভিযান শুরু হলেও মাঝপথে তা আটকে গেছে। এরপর আর সেখানে অভিযান পরিচালিত হয়নি। এতে অন্যান্য দখলদারও ছাড় পেয়ে গেছে।
এ বিষয়ে নারায়ণগঞ্জের জেলা প্রশাসক মোস্তাইন বিল্লাহ বলেন, ‘জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের প্রতিবেদনটি আমরা এখনো পাইনি। তবে গত ২৮ জানুয়ারি জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের সঙ্গে এ বিষয়ে সভা হয়েছে।’ মেঘনা গ্রুপের নদী দখল প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘এ বিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের নির্দেশনার অপেক্ষায় আছি। নির্দেশনা পাওয়া মাত্রই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
এ বিষয়ে সোনারগাঁ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আতিকুল ইসলাম বলেন, ‘শুধু মেঘনা গ্রুপের দখলে থাকাই নয়, অন্যান্য শিল্পপ্রতিষ্ঠানের দখলের তালিকা করেও জেলা প্রশাসকের নির্দেশক্রমে নদীর জায়গা উদ্ধারে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’