
ভ্রমনে জ্ঞান
মোরসেদুল আলমঃ পাঠ ও পর্যালোচনার পাশাপাশি ভ্রমণ, কবিতা, গান, চলচ্চিত্রের মাধ্যমে আমরা নিজেদেরকে সমৃদ্ধ করতে চাই। তারই ধারাবাহিকতায় আজকে আমাদের পাঠযাত্রা’র আয়োজন করা হয়। গশ্চি নয়া হাট থেকে শুরু করে খেলার ঘাট, আমরা মিলিত হই প্রাণের টানে। সেখানে বোয়ালখালী থেকে পাঠাগারের বন্ধুরাও যুক্ত হয়। এরপর সবাই মিলে বোটে করে কর্ণফুলী নদীতে ভাসতে ভাসতে রিভার ভিউতে গিয়ে পৌঁছাই। কর্ণফুলীর চিরায়ত অপরূপ দৃশ্য আমাদেরকে বিমোহিত করে।
পৃথিবীর সকল সভ্যতা গড়ে উঠেছে নদীকেন্দ্রিক। এখনো যেকোনো নদীমাত্রই অপার প্রাকৃতিক ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির সম্ভাবনাকেই জাগিয়ে রাখে। সেই সম্ভাবনাকে যথার্থ রূপ দেওয়া মানে নদীকে শাসন করে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির উপায়-অবলম্বন-মাত্র করে রাখা নয়। প্রয়োজন নদী ও প্রকৃতির জীবন্ত সত্তাকে উপলব্ধি করতে পারা। প্রয়োজন মানুষ, নদী ও প্রকৃতির একে অপরের তরে বেঁচে থাকা। বলা বাহুল্য, পুঁজির কাছে বিক্রি হয়ে যাওয়া মানুষ- জীবনের শৃঙ্খলাকে ভেঙ্গে-চূড়ে দুমড়ে-মুচড়ে দিয়ে অশ্ব বেগে কোথায় ছুটেছে সে নিজেও তা জানে না, তার ঘোড়াটিও যে অন্ধ তা-ও তার অজ্ঞাত। সেই অন্ধ ঘোড়ার লাগাম ধরবে কে?
কর্ণফুলী আমাদের কাছে অনেক তাৎপর্যপূর্ণ। কর্ণফুলীকে দখল-দূষণের হাত থেকে রক্ষা করা আমাদের নৈতিক দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। আমরা প্রকৃতির অংশ, আবার প্রকৃতিও আমাদের অংশ। বাতাসের সজীবতা জলের স্বচ্ছতা-তো আমাদের ব্যক্তিগত সম্পত্তি নয়। নদীমাতৃক যে বাংলাদেশ গড়ে উঠেছিলো সেদেশের নদীগুলোকে আমরা কিছুতেই ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিতে পারি না। আমরা মনেকরি গণমানুষের সচেতনতা ও সমবেত প্রচেষ্টা বাংলাদেশের নদীগুলোকে বাঁচিয়ে তুলবে। কর্ণফুলীকে রক্ষা করার দায়িত্ব প্রত্যক্ষভাবে আমাদের, এই অঞ্চলের সকল মানুষের।
‘কর্ণফুলী’ নাম নিয়ে উপাখ্যানটা হলোঃ পার্বত্য চট্টগ্রামের এক আদিবাসী রাজকুমারের সঙ্গে প্রণয়াসক্ত আরাকানের রাজকুমারী এক জোছনাপ্লাবিত রাতে নদীতে নৌ-বিহার করছিলেন। জোছনার আলো নদীতে পড়ে সোনালি তরঙ্গের মতো এক অপরূপ নৈসর্গিক শোভা সৃষ্টি করেছিল। তাই রাজকুমারী বারবার নদীর জল স্পর্শ করছিলেন। হঠাৎ তার প্রিয় কানফুলটি নদীতে পড়ে যাওয়ায় সেটি ফিরে পেতে তক্ষুনি নদীতে তিনি লাফিয়ে পড়েন। নদীর স্রোত রাজকুমারীকে ভাসিয়ে নিতে থাকলে রাজকুমারও তাকে উদ্ধারের উদ্দেশ্যে নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়েন। কিন্তু রাজকুমারীকে উদ্ধার করতে না পেরে ওই নদীর জলে নিজেও আত্মহুতি দেন। সেই বিয়োগান্তক ঘটনার স্মরণে নদীটির নামকরণ হয়েছে কর্ণফুলী।
‘লুসাই’ নামের একটি পর্বতমালা রয়েছে, যেটি এখন মিজো পর্বতমালা হিসেবেই পরিচিত। মিজোরামের পাটকাই অঞ্চল এবং ত্রিপুরা রাজ্যের কিছু অংশে এই পর্বতমালার অবস্থান। ভারতের একেবারে দক্ষিণ-পূর্ব এলাকার রাজ্য মিজোরামের বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী এলাকার লুংলেই জেলায় কর্ণফুলীর জন্ম। সেখান থেকে প্রায় ২০ কিলোমিটার দূরে ঠেগামুখ হয়ে বাংলাদেশে ঢুকেছে কর্ণফুলী। পশ্চিমবঙ্গের সুবর্ণরেখা ও পূর্ববঙ্গের কর্ণফুলী নদী স্বাধীনভাবে সমুদ্রে প্রবেশ করেছে। বাংলাদেশ অংশে কর্ণফুলীর দৈর্ঘ্য পানি উন্নয়ন বোর্ড কর্তৃক ১৬০ কিলোমিটার বলে পরিমাপ করা হয়েছে। নদীর প্রস্থ ১৫০ মিটার। নদীর গভীরতা ১৫ মিটার। নদী অববাহিকার আয়তন এক হাজার ২৯৬ বর্গ কিলোমিটার। দেশের অর্থনীতিতে কর্ণফুলী নদীর অবদান অনেক। কর্ণফুলীতে দৈনিক ২২ হাজার টন শক্ত ও তরল বর্জ্য ফেলা হচ্ছে। সাধারণত ঘরবাড়ি, কল-কারখানা ও বিভিন্ন হাসপাতালের বর্জ্য সেখানে ফেলা হচ্ছে। আমরা এটুকু জানি মাটি মানুষের নয় বরং মানুষই মাটির। রক্ত যেমন আমাদের একসূত্রে বেঁধেছে, তেমনি সমস্ত জিনিসও পরস্পরে বাঁধা। জীবনের জাল মানুষ বয়ন করেনি। সে তো এই জালেরই একটি সূতো। এই জালের ক্ষতি করা মানে নিজের ক্ষতি করা। কর্ণফুলী আমাদের কাছে সাংস্কৃতিক-অর্থনৈতিক-রাজনৈতিকভাবে খুবই গুরুত্ব বহন করে। সামনে বিশ্ব রাজনীতিতে সুপেয় বা মিঠা পানির বাণিজ্য হবে, এমনও হতে পারে মিঠা পানির জন্য দেশে দেশে যুদ্ধ লাগবে। কর্ণফুলী আমাদের পথ দেখাবে, সাহস জোগাবে।