
প্রণোদনার বীজ হাওয়া, বিপাকে শত শত কৃষক
সরকারের প্রণোদনার বীজ পাচ্ছে না কৃষকরা। কলাপাড়া পৌর শহরের বীজ বিক্রয় কেন্দ্রগুলোতে গিয়ে দেখা গেছে, শত শত কৃষক হাতে টাকা নিয়ে এক দোকান থেকে অন্য দোকানে ঘুরছেন। সরকারি বীজধানের ওপর আস্থা থাকায় বেসরকারি বীজধানের ওপর আস্থা আনতে পারছেন না কৃষক। কৃষি বিভাগের নির্ধারিত ডিলারের কাছে বীজধান না পাওয়ায় কৃষকরা শহরের সব দোকানেই ভিড় করছেন। কিন্তু বীজের দাম দরিদ্র কৃষকদের নাগালের বাইরে। কৃষকদের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা এবং ক্ষিপ্ত প্রশ্নের বাণে অসহায় বীজ বিক্রেতারাও।
বীজ কিনতে আসা চারিপাড়া গ্রামের কৃষক মো. আমজেদ গাজী বলেন, ‘আমরা রাবনাবাদ নদের ভাঙ্গুলী এলাকার মানুষ। ঘূর্ণিঝড় বুলবুলের কারণে জমির ধান নষ্ট অইয়্যা গ্যাছে, বীজ রাখতে পারি নাই। সরকারি বীজধান না পাইয়া বেসরকারি কম্পানির ১০ কেজি বিআর-১১ জাতের ধান কিনছি ৯০০ টাকায়, যে বীজের আসল দাম অনেক কম। এহন দোকানদাররা মোগে ধারে চড়া মূল্যে বীজধান বিক্রি করতে আছে।’
টিয়াখালী ইউনিয়নের চাষি মো. শামিম বলেন, ‘ডিলারের ধারে বীজের জন্য প্রায় এক সপ্তাহ ঘুরছি, না পাইয়া ধৈর্য হারাইয়া প্রতিবেশীর কাছ থিকা দুই হাজার টাহা ধার নিয়া বীজ কিনছি। এহনো ৩০ কেজি বীজধান লাগবে, কোম্মে পামু, কইতে পারি না। যদি সরকারি বীজধান না পাই তা হইলে জমি চাষ করা অসম্ভব অইয়া পড়বে।’
এ ব্যাপারে বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের ডিলার গৌতম চন্দ্র হাওলাদার জানান, গত বছর ঘূর্ণিঝড় বুলবুলের কারণে কোনো কৃষক বীজধান সংরক্ষণ করেতে পারেননি। এ কারণে কৃষকের মাঝে এ বছর বীজধানের তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। কৃষি অধিদপ্তর থেকে মাইকিং করা হয়েছে যে ১৯৫০ সালের আইন অনুযায়ী কোনো জমির মালিক জমি পতিত বা চাষাবাদের বাইরে রাখতে পারবেন না। যদি জমি চাষাবাদের বাইরে রাখে তবে জমি সরকার অধিগ্রহণ করে নিয়ে যাবে। এ কারণে অনেক প্রান্তিক বা বর্গা চাষি ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পড়ছে। প্রকৃত জমির মালিকরা নিজ জমি চাষাবাদে লিপ্ত হচ্ছে। এই কারণেও এই বছর বীজধানের চাহিদা বেড়েছে। এখন সরকারের প্রণোদনা এবং আপৎকালীন সংরক্ষিত বীজ যদি দ্রুত সরবরাহ করা না হয়, তবে বহু কৃষকের জমি অনাবাদি থাকার আশঙ্ক রয়েছে। তিনি বলেন, ‘আমি এ পর্যন্ত ১২ টনের মতো বীজধান পেয়েছি। বিআর-১১ জাতের ধানের ১০ কেজি বস্তা বেচেছি ২৯০ টাকায়। বিআর-২৩ জাতের ধানের ১০ কেজি বস্তা ৩০০ টাকা। বিআর-২২ জাতের ধানের ১০ কেজি বস্তা ২৯০ টাকা। ব্রি ধান-৪৯ জাত ৩০০ টাকা। ভিত্তি বীজ ৩৮০ টাকা। ব্রি-৫১ জাতের ধানের বস্তা ৩০০ টাকা। ব্রি-৫২ জাতের ধানের বস্তা ২৯০ টাকা দরে বেচেছি। এখন বীজ নাই। অলস বসে আছি, আর কৃষকদের নানা প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছি।’ তিনি আরো জানান, তিন টন বিআর-২৩ জাতের বীজধানের পে-অর্ডার কাটানো আছে। সেই ধান পাননি। তিনি কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করেও বীজধান পেতে ব্যর্থ হয়েছেন। বীজসংকটের কারণে প্রতিদিন দুই থেকে পাঁচ শতাধিক কৃষক তাঁর কাছে আসেন। বীজ না থাকায় শূন্য হাতে কৃষকদের বড়ি ফিরে যেতে হচ্ছে।
বেসরকারি কম্পানির বীজ বিক্রেতা মো. সোহেল জানান, তিনি বিভিন্ন কম্পানির বীজধান বিক্রি করেন। বেবিলন কম্পানির বিআর-১১ জাতের দুই কেজি ভিত্তি বীজের প্যাকেট ২৩০ টাকা। প্রত্যয়িত বীজ ৪৯ জাতের ১০ কেজির বস্তা ৬৫০ টাকা। ইস্পাহানী ব্রি-১১ জাতের ভিত্তি বীজ ১০ কেজির বস্তা ৭০০ টাকা। ১০ কেজির বস্তা ৮০০ থেকে ৯০০ টাকা।
কলাপাড়া উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আবদুল মন্নান জানান, কলাপাড়া উপজেলার ৩৫ হাজার ৫০০ হেক্টর জমিতে আমন ধান চাষের লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে। এর মধ্যে উফশী ধান চাষ হচ্ছে ২৪ হাজার ৪০০ হেক্টর জমিতে। এই জমিতে বীজধানের চাহিদা রয়েছে ৬০০ টনের। স্থানীয় বীজ দিয়ে কৃষকরা ১১ হাজার ৫০০ হেক্টর জমি চাষ করেন। সেখানে বীজের চাহিদা রয়েছে ৩০০ টনের মতো। কিন্তু কলাপাড়া উপজেলায় সরকারি বীজ বরাদ্দ আছে ৪৮ থেকে ৫০ টনের। কিছু বীজ পাওয়া যায় কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের ডেমো চাষির সংগ্রহশালা থেকে। ১০ বস্তার ভিত্তি বীজ ৫০০ টাকা হলেও সরকার ১২০ টাকা ভর্তুকি দিয়ে কৃষকদের কাছে ৩৮০ টাকা বিক্রি করে। প্রত্যয়িত বীজধানের মূল্য ৪৪০ টাকা হলেও সরকার ১৪০ টাকা ভর্তুকি দিয়ে কৃষকের কাছে ৩০০ টাকা বিক্রি করে। তিনি বলেন, ‘আপৎকালীন বীজ থেকে সংকটময় মুহূর্তে কৃষকদের চাহিদা মেটানোর জন্য আমি সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের কাছে আবেদন করেছি। আশা করি, দু-এক দিনের মধ্যে বীজ পাওয়া যাবে।’