
আজ বিশ্ব জীববৈচিত্র্য দিবস
আজ ২২ মে বিশ্ব জীববৈচিত্র্য দিবস। এ বছর আন্তর্জাতিক জীববৈচিত্র্য দিবসের প্রতিপাদ্য করা হয়েছে, ‘প্রকৃতির মাঝেই আমাদেরসমাধান’ (Our Solutions are in Nature)।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরিসংখ্যান অনুযায়ী, পৃথিবীতে প্রতিবছর ১০০ কোটি মানুষের অসুস্থতা এবং কয়েক লাখ মানুষের মৃত্যুরজন্য দায়ী বিভিন্ন ধরনের প্রাণীর দেহ থেকে আসা রোগজীবাণুর সংক্রমণ। সংস্থা বলছে, বর্তমান ছোঁয়াচে রোগগুলোর ৬০শতাংশই এসেছে বিভিন্ন ধরনের প্রাণী থেকে। ইউএস এইডসের একটি প্রকল্প প্রতিবেদন থেকে জানা যাচ্ছে, বিভিন্ন ধরনের প্রাণীথেকে মানবদেহে রোগ সৃষ্টি করতে সক্ষম এমন প্রায় এক হাজার ভাইরাস প্রজাতি শনাক্ত করা হয়েছে। এর আগে শনাক্তকৃতঅনেক ভাইরাস (ইবোলা, এইচআইভি, নিপাহ, সার্স, মার্স ইত্যাদি) প্রাণিকুল থেকে এসেছে বলে প্রমাণ পাওয়া গেছে।
বিজ্ঞানীরা বলছেন, জীববৈচিত্র্য হ্রাস পাওয়া এবং তাদের, বিশেষ করে বন্য প্রাণীদের বাছবিচারহীনভাবে ব্যবহার (খাদ্য, ওষুধতৈরি) করার কারণে নানা ধরনের রোগজীবাণু এই সব প্রাণী থেকে সরাসরি কিংবা গৃহপালিত পশু–পাখির মাধ্যমে মানবদেহেপ্রবেশ করছে। ভারসাম্যময় জীববৈচিত্র্যপূর্ণ একটি এলাকায় রোগজীবাণুর বিভিন্ন প্রজাতি বিভিন্ন জীবদেহে আশ্রয় গ্রহণ করেবেঁচে থাকে। সে কারণে জীববৈচিত্র্যসমৃদ্ধ এলাকায় মানুষের রোগ–ব্যাধির ঝুঁকি কম থাকে। এটাকে বলা হয় ‘দ্য ডাইলিউশনএফেক্ট’ বা ‘তরলিত প্রভাব’। মানুষের জন্য জীববৈচিত্র্যের এ এক অনবদ্য সেবা।
আসলে জীববৈচিত্র্য মানুষকে বাস্তুতান্ত্রিক সেবা দেয় বলেই আমরা পৃথিবীতে এখনো বেঁচে আছি। এই যে আস্ফাানের প্রথমআঘাত, তাকে কিন্তু জৈব ঢাল হিসেবে যতটা সম্ভব রুখে দিয়েছে সুন্দরবন। জীববৈচিত্র্যের বাস্তুতান্ত্রিক সেবাকে মোট চার ভাগেভাগ করা হয়। এগুলো হচ্ছে : ১. দ্রব্যগত সেবা (খাদ্যশস্য, কাঠ, জৈব জ্বালানি, ওষুধ ইত্যাদি); ২. নিয়ামক সেবা (জলবায়ুনিয়ন্ত্রণ, পরাগায়ণ, পানি পরিষ্কারকরণ, বর্জ্য পরিশোধন, জীবতাত্ত্বিক নিয়ন্ত্রণ, মাটির স্বাস্থ্য রক্ষা ইত্যাদি); ৩. সহায়ক সেবা(পুষ্টি চক্র, সালোকসংশ্লেষ, মাটি গঠন ইত্যাদি) ও ৪. সাংস্কৃতিক সেবা (গাছপালাযুক্ত প্রাকৃতিক দৃশ্য, বিভাময় প্রাণীদের দর্শন, জলচর জীব দর্শন ইত্যাদি)। জীববৈচিত্র্যের এই সেবাগুলো ছাড়া আমরা আমাদের বেঁচে থাকার কথা চিন্তাই করতে পারি না।
অথচ আমরা প্রতিনিয়ত জীববৈচিত্র্যবিরোধী সব কর্মকাণ্ড করে চলি। প্রায় ২৮ বছর আগে (জুন ১৯৯২) রিও ধরিত্রী সম্মেলনেবিশ্বনেতারা প্রায় সবাই কথা দিয়েছিলেন, জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে সবাই কাজ করবেন। কাজ যে করা হয়নি তা বলা যাবে না।স্থানীয়, আঞ্চলিক কিংবা বৈশ্বিকভাবে অসংখ্য গবেষণা, কর্মপরিকল্পনা, নীতিমালা, প্রকল্প ইত্যাদি সম্পন্ন হয়েছে কিংবা হচ্ছে।কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, এত কিছুর পরও জীববৈচিত্র্য ক্রমাগতভাবে সংকুচিত হয়ে চলেছে। সিবিডির ১০ বছর মেয়াদি (২০১০–২০২০) কর্মকৌশলও খুব একটা সফল হয়নি। এর অন্যতম কারণ হচ্ছে বাস্তবায়নগত সমস্যা।
আসলে জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণকে বিচ্ছিন্ন একটি কাজ হিসেবে দেখলে হবে না। একে উন্নয়নের সঙ্গে সমন্বয় করে সেভাবেই তারবাস্তবায়ন প্রয়োজন। সিবিডি ২০২০ সাল পরবর্তী (২০৫০ পর্যন্ত) বৈশ্বিক জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে কিছু প্রস্তাব তৈরি করেছে। সেগুলোহচ্ছে : মিঠা পানি, সামুদ্রিক ও স্থলজ বাস্তুতন্ত্র পুনরুদ্ধার; গুরুত্বপূর্ণ জীববৈচিত্র্য এলাকাগুলো সংরক্ষণের আওতায় নিয়ে আসা; বর্তমান সংরক্ষিত এলাকাগুলোতে সংরক্ষণ কার্যক্রম আরো জোরদার করা; আগ্রাসী প্রজাতিগুলো নিয়ন্ত্রণ; জীবনাশক, প্লাস্টিকবর্জ্য ও অন্যান্য দূষণ হ্রাস করা; বন্য প্রজাতি আহরণ ও তাদের নিয়ে ব্যবসা সহনীয় পর্যায়ে নিয়ে আসা; জীববৈচিত্র্যের ওপরনেতিবাচক প্রভাব সৃষ্টিকারী জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়টিকে বিবেচনায় নিয়ে তার প্রশমন ও অভিযোজনকাজে সম্পৃক্ত হওয়াইত্যাদি। এগুলো অবশ্য নতুন কোনো কিছু নয়, সিবিডি আগেও বলেছে। আসলে সিবিডিতে স্বাক্ষরকারী দেশগুলোর আন্তরিকসহযোগিতা ছাড়া এগুলো বাস্তবায়ন অসম্ভব।
আমাদের বুঝতে হবে, যত চোখ–ধাঁধানো ইমারত, স্থাপনা, কলকারখানা, নিত্যনতুন যন্ত্র, সমরাস্ত্র, পরিবহনব্যবস্থা, ব্যবসা–বাণিজ্য কিংবা ডিজিটাল উন্নতি করি না কেন, জীববৈচিত্র্য ক্ষতিগ্রস্ত হলে বা তার ভারসাম্যে বিশৃঙ্খলা দেখা দিলে আমরা সুস্থকিংবা বেঁচে থাকতে পারব না। সে কারণে সিবিডিসহ জাতিসংঘের অনেকগুলো সংস্থা কয়েক বছর আগে থেকেই সর্বক্ষেত্রেপ্রকৃতিবান্ধব সমাধানের কথা বলে আসছে। জীববৈচিত্র্যকে যথাযথভাবে সংরক্ষণ করা প্রকৃতিবান্ধব সমাধানের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণঅংশ।
এই মুহূর্তে কেউ বলতে পারছেন না যে কভিড–১৯ কত দিন পর নিষ্ক্রিয় হবে কিংবা আদৌ নিষ্ক্রিয় হবে কি না। সার্স ভাইরাস(কোভ–১) নিষ্ক্রিয় হলেও ইবোলা, এইচআইভি, নিপাহ, মার্সসহ অনেক ভাইরাস কিন্তু এখনো সক্রিয়। কারো কারো প্রকোপহয়তো কমে এসেছে। পরিসংখ্যান বলছে, কভিড–১৯ আক্রান্ত বেশির ভাগ মানুষ প্রধানত সুস্থ হয়ে উঠছে তাদের সহজাত রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতার জোরে। তাই এ ভাইরাসের বিরুদ্ধে সঠিক ওষুধ কিংবা টিকা আবিষ্কারের পর তা পৃথিবীর সব অঞ্চলের সবশ্রেণির মানুষের কাছে সহজলভ্য না হওয়া পর্যন্ত মানুষকে প্রধানত তার রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার ওপর নির্ভর করেই বাঁচতে হবে।ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, গুটিবসন্তের টিকা আবিষ্কারের (১৭৯৬) পর পৃথিবী থেকে গুটিবসন্ত নির্মূল (১৯৮০) হতে ১৮৪ বছর সময়লেগেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন যে ভবিষ্যতে আরো নতুন ভাইরাস আসতে পারে।
কাজেই এ ধরনের অনিশ্চিত একটি পরিস্থিতিতে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাসম্পন্ন সুস্থ মানুষের খুব বেশি প্রয়োজন। তবে এর জন্যদরকার স্বাস্থ্যকর পরিবেশ। আর সেই স্বাস্থ্যকর পরিবেশ পাওয়ার অন্যতম শর্ত হচ্ছে আমাদের চারপাশে ভারসাম্যময় সমৃদ্ধজীববৈচিত্র্য। আমাদের বেঁচে থাকার জন্য এটি খুবই জরুরি। কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের ভাষায়, ‘মন্বন্তরে মরিনি আমরা মারী নিয়েঘর করি, বাঁচিয়া গিয়াছি বিধির আশিষে অমৃতের টীকা পরি।’ জীববৈচিত্র্য, পরিবেশ ও প্রকৃতির মাঝেই লুকিয়ে আছে সেইঅমৃতের টীকা। তার কাছেই আমাদের সমাধান খুঁজতে হবে। সুপার সাইক্লোন আস্ফাান বিশ্বমারি কভিড–১৯ আমাদের চোখেআঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল।