
লাল মৃত্যুর মুখোশ – এডগার অ্যালান পো’র গল্প
[মার্কিন কবি-গল্পকার এডগার অ্যালান পো (Edgar Allan Poe, ১৮০৯-১৮৪৯)’র লেখা বিখ্যাত গল্প ‘দা মাস্ক অব দা রেড ডেথ’ (The Masque of the Red Death) বর্তমান করোনাপীড়িত সময়ে বড় প্রাসঙ্গিক মনে হওয়ায় ‘লাল মৃত্যুর মুখোশ’ শিরোনামে ধারাবাহিক অনুবাদের ও আপনাদের দরবারে উপস্থাপনার সিদ্ধান্ত নেয়া হলো।গল্পটি প্রথম প্রকাশিত হয় ১৮৪২ সালে। এটা হলো ‘লাল মৃত্যু’ নামে এক মহামারীর সংক্রমণ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্যে জনবিচ্ছিন্ন জীবনযাপনের গল্প, ঠিক যেমনটা এখন আমরা করছি করোনাভাইরাস সংক্রমণের ভয়ে।
যুক্তরাষ্ট্রের কবি, ছোট গল্পকার, সম্পাদক, সমালোচক এবং রোম্যান্টিক আন্দোলনের অন্যতম নেতা এডগার অ্যালান পো (Edgar Allan Poe, ১৯ জানুয়ারি, ১৮০৯ – ৭ অক্টোবর, ১৮৪৯)’র পরিচয় সাহিত্যামোদীদের কাছে নতুন করে দেয়ার কিছু নেই। বৈচিত্র্যময় জীবনের অধিকারী এই প্রতিভাবান সাহিত্যিকের সারা জীবন কেটেছে নানা রকম যন্ত্রণা, আর্থিক দৈন্য ও মানসিক অস্থিরতার মধ্যে। বিশ বছর বয়স হবার আগেই তিনি লেখালেখি শুরু করেন এবং তখনই তাঁর কিছু কিছু রচনা প্রকাশিত হয়। ১৮৪৯ সালে, মাত্র ৪০ বছর বয়সে, এক রহস্যজনক পরিস্থিতিতে পো’র মৃত্যু ঘটে।
জীবদ্দশায় একদিকে তিনি অসংযমী জীবনযাপন করেছেন, জুয়ো খেলেছেন, অসুস্থ হয়েছেন, মাদকসেবন করেছেন। মৃত্যুর এক বছর পূর্বে ঘুমের বড়ি খেয়ে একবার আত্মহত্যার চেষ্টাও করেন। অন্য দিকে এতসবের মধ্যেও কয়েকটি গভীর আবেদনময় কবিতা ও ব্যতিক্রমধর্মী ছোটগল্প রচনা করে শুধু মার্কিন সাহিত্যভুবনে নয়, বিশ্বসাহিত্যের অঙ্গনে নিজের জন্য একটি গৌরবমণ্ডিত স্থায়ী আসন করে নিয়েছেন। তাঁর বিখ্যাত কবিতাগুলির মধ্যে রয়েছে ‘হেলেনকে’’, ‘স্বপ্ন’, ‘ইজাবেল’, ‘দাঁড়কাক’, ‘অ্যানাবেল লী’ প্রভৃতি। ‘দা রেভেন’ বা ‘দাঁড়কাক’ কবিতাটি রোম্যান্টিকতা, মোহন সুরেলা ছন্দোময়তা ও তার রহস্যময় পরিমণ্ডলের জন্য বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবিতারূপে স্বীকৃতি পায়।
পো তাঁর বেশ কয়েকটি ছোটগল্পে উল্লেখযোগ্য নৈপুণ্যের সঙ্গে রহস্যময়, ভুতুড়ে, মৃত্যুর গন্ধমাখা, খুনখারাবি ভরা, আতঙ্কতাড়িত পরিবেশ সৃষ্টি করেছেন। গোয়েন্দা-গল্পের ক্ষেত্রেও তাঁর অবদান স্মরণীয়। উপরিউক্ত ধারার রচনার মধ্যে ‘আমন্তিলাডোর পিপা’, ‘কালো বিড়াল’, ‘রু মর্গের হত্যাকাণ্ড’ এবং ‘চুরি যাওয়া চিঠি’ তাকে আন্তর্জাতিক খ্যাতি এনে দেয়। তাঁর উচ্চমানের রচনাশৈলী এবং প্রতীকবাদী দৃষ্টিভঙ্গির উচ্চ প্রশংসা করেছেন পরবর্তী কালের অনেক শ্রেষ্ঠ সাহিত্যিক। এঁদের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হলেন আইরিশ কবি ডব্লিউ. বি. ইয়েট্স্, ফরাসি কথাসাহিত্যিক মপাসাঁ, কবি শার্ল বদ্ল্যের ও পল ভালেরি।
বাংলা সাহিত্যেও বিপুল প্রভাব এই বিশ্ববিশ্রুত লেখকের। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ থেকে শুরু করে রবীন্দ্র-পরবর্তী যুগের কবি-সাহিত্যিকেরা অনেকেই প্রভাবিত হয়েছেন পো’র রচনা পড়ে। রবীন্দ্রনাথের ‘একই গাঁয়ে’ আর এডগার অ্যালেন পো’র ‘অ্যানাবেল লি’র মধ্যে মিল এতটাই বেশি যে, প্রথমটাকে দ্বিতীয়টার ভাষান্তর বা ভাবান্তর বলেই সাহিত্যবিদদের অনেকে মনে করেন। আবার অনেকের মতে, জীবনানন্দ দাশের অতি বিখ্যাত কবিতা ‘বনলতা সেন’-এর উৎস এডগার অ্যালান পো’র কবিতা ‘টু হেলেন’। এ দুটো কবিতার মধ্যেকার মৌলিক মিলগুলোও বিস্ময়কর।
দীর্ঘদিন ধরে দেশকে উজাড় করে ফেলছে লাল মৃত্যু। অতীতে আর কখনো কোনো মহামারী এমন মারাত্মক বা ভয়াবহ হতে দেখা যায় নি। রক্তই হলো এর অবতার, আর এর সিলমোহর হলো রক্তের উন্মত্ততা এবং বীভৎসতা। তীব্র একটা যন্ত্রণা, হঠাৎ করে মাথায় চক্কর লাগা, তারপর লোমকূপ দিয়ে প্রচুর রক্তপাত, আর তারপর সব শেষ। এ রোগে আক্রান্তের শরীরে, বিশেষ করে সারা মুখে, লেগে থাকা রক্তের ছোপ ছোপ দাগ দেখা দিলে সংক্রমণের ভয়ে কেউ সেবা-শুশ্রূষার জন্যে তার কাছে ঘেঁষে না। রোগের আক্রমণ, অগ্রগতি এবং আক্রান্তের জীবনাবসান– সব মিলিয়ে আধঘণ্টার বেশি সময় লাগে না।
এ নিয়ে প্রিন্স প্রস্পেরোর মনে কিন্তু কোনো ভয়ডর ছিলো না। বিচক্ষণ মানুষটি বেশ প্রফুল্ল চিত্তেই ছিলেন। তাঁর জমিদারি এলাকাগুলোর প্রায় অর্ধেক মানুষই যখন মারা পড়লো, তখন তিনি তাঁর দরবারের নাইট আর বিবিদের মধ্যে থেকে হাজারখানেক সুস্থসমর্থ আর আমুদে বন্ধুবান্ধবকে ডেকে পাঠালেন। তারপর তিনি তাদেরকে নিয়ে গা ঢাকা নিলেন তাঁর সুউচ্চ প্রাচীরে ঘেরা বাসভবনের সম্পূর্ণ জনবিচ্ছিন্ন অন্দরমহলে। ওটা ছিলো প্রিন্সের নিজস্ব উৎকেন্দ্রিক অথচ অভিজাত রুচির সৃষ্টি একটা বিশাল প্রাসাদ। একটা সুদৃঢ় আর গর্বোন্নত প্রাচীর এটাকে মালার মতো ঘিরে রেখেছিলো। দেয়ালটার ফটকগুলো ছিলো লৌহনির্মিত। সভাসদরা সবাই ভেতরে ঢোকার পর আগুনের শিখায় গলিয়ে এবং ভারী হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে ফটকগুলোর সমস্ত খিল পাকাপাকিভাবে ঝালাই করে দেয়া হলো।
একটা তাৎক্ষণিক হতাশা বা আতঙ্কের বশে তারা ঢোকার আর বের হওয়ার সব পথ বন্ধ করে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো। আস্তানাটা প্রচুর রসদে ভর্তি করা হয়েছিলো। এতটা সাবধানতা অবলম্বন করে সভাসদরা সংক্রমণ এড়াতে পারবে বলে ভেবেছিলো। এবার বাইরের দুনিয়া তার সমস্যা নিয়ে মাথা ঘামাক। এ ফাঁকে হাতে পাওয়া সময়টুকুতে হাহুতাশ বা দুর্ভাবনা করাটা একটা বিরাট বোকামো হবে। প্রিন্স বিনোদন ও উপভোগের সব উপকরণের ব্যবস্থা রেখেছিলেন। এখানে ভাঁড়, কবিয়াল, গাইয়ে, ব্যালে নর্তকী সবকিছু ছিলো। এখানে ছিলো অফুরান সুরা আর সুন্দরী নারীরা। প্রাচীরঘেরা এ প্রাসাদের ভেতরে ছিলো এই সবকিছুই, আর সেইসঙ্গে নিরাপত্তাও। ‘লাল মৃত্যু’র এখানে কোনো ঠাঁই ছিলো না।
এভাবে জনবিচ্ছিন্ন থাকার পঞ্চম বা ষষ্ঠ মাসে পৌঁছার পর প্রিন্স প্রস্পেরো ওই প্রাসাদে তাঁর হাজারখানেক বন্ধুকে আনন্দ দিতে এক জাঁকজমকপূর্ণ মুখোশধারী বলনাচের আয়োজন করলেন, যেমনটা আগে কখনও করেন নি।
সেই মুখোশ নাচ এক ইন্দ্রিয়বিলাসী অনুষ্ঠান ছিলো বটে! তবে যেসব কামরায় অনুষ্ঠানটির আয়োজন করা হয়েছিলো, প্রথমে সেগুলোর একটু বর্ণনা দেয়া যাক। প্রাসাদের এক রাজকীয় মহলে ওরকম কক্ষ ছিলো সাতটি। অনেক প্রাসাদে এ ধরনের কামরাগুলো মিলে দীর্ঘ আর সোজাসুজি একটা দৃষ্টিপথের সৃষ্টি করে। কামরাগুলোর ভাঁজ করা দরজাগুলো দুপাশের দেয়ালের দিকে গুটিয়ে রাখা হলে এ প্রান্তের কামরায় বসে ও প্রান্ত পর্যন্ত দৃষ্টি আর কোথাও ব্যাহত হয় না। কিন্তু এ ক্ষেত্রে ব্যাপারটা ছিলো সম্পূর্ণ আলাদা, সম্ভবত ‘উদ্ভট’ জিনিসের প্রতি প্রিন্সের অনুরাগের কারণে। এমন এলোমেলোভাবে এই কক্ষগুলো তৈরি করা হয়েছিলো, যাতে একবারের দৃষ্টিপাতে একটার চেয়ে বেশি জিনিস একসঙ্গে চোখে পড়তে না পারে। প্রতিটি দেয়ালের মাঝখানে ছিলো ডানে-বামে একটা তীক্ষ্ণ দিকবদল। প্রত্যেক দেয়ালে গথিক স্থাপত্যরীতিতে তৈরি একটা করে লম্বা আর সংকীর্ণ জানালা তাকিয়ে ছিলো বাইরে মহলের মধ্যে দিয়ে এঁকেবেঁকে চলে যাওয়া একটা বদ্ধ করিডরের দিকে।
জানালাগুলো ছিলো রঙ করা কাঁচের। ঘরের ভেতরকার সাজসজ্জা যখন যেমন, তার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে জানালাগুলোর কাঁচের রঙ পাল্টাতো। যেমন ধরুন, পূর্বতম প্রান্তের ঘরটি সাজানো হয়েছিলো নীল রঙের উপকরণে, আর সেটার জানালাগুলোও ছিলো উজ্জ্বল নীল। দ্বিতীয় কক্ষের সাজসজ্জা, ট্যাপেস্ট্রি ইত্যাদি সব ছিলো লালচে বেগুনি রঙের, এবং এখানকার জানলার কাঁচগুলোও ছিলো লালচে বেগুনি। তৃতীয় কামরাটির আগাগোড়া ছিলো সবুজ, এবং তার জানালার কাঁচও তাই। চতুর্থ, পঞ্চম এবং ষষ্ঠ কক্ষ সাজানো হয়েছিলো যথাক্রমে কমলা, সাদা এবং বেগুনি রঙের গৃহসজ্জা আর আলো দিয়ে। সপ্তম কামরাটা নিবিড়ভাবে ঢাকা ছিলো কালো মখমলের পর্দা দিয়ে। ভারী পর্দাগুলো দেয়ালগুলোকে আড়াল করে ছাদ থেকে ভাঁজে ভাঁজে নেমে এসেছিলো একই উপকরণ আর রঙে তৈরি গালিচার ওপর। কিন্তু শুধুমাত্র এ কামরাটায় গৃহসজ্জার রঙের সঙ্গে জানালার কাঁচের রঙের কোনো মিল ছিলো না। কাঁচগুলো ছিলো টকটকে লাল রঙের– রক্তের মতো গাঢ় লাল।
এদিকে সাতটা কামরার প্রতিটাতেই ইতস্তত ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছিলো আর ছাদ থেকে ঝুলছিলো সোনার তৈরি নানা গৃহসজ্জার সামগ্রী, অথচ কোনো কামরাতেই কোনো বাতি বা ঝাড়লন্ঠন ছিলো না। কামরাগুলোর ভেতরে কোনো ল্যাম্প বা মোমবাতির আলো দেখা যেতো না। কিন্তু কামরাগুলোর বাইরেকার করিডোরে প্রতিটি জানালার বিপরীতদিকে বসানো ছিলো জ্বলন্ত আগুনের একটি করে রৃহদাকার মালসা, যেখান থেকে আগুনের শিখার ছটা জানালার রঙ করা কাঁচের পাল্লার মধ্যে দিয়ে গিয়ে ঘরগুলোকে ঝলমলিয়ে আলো করে তুলতো। এর ফলে ঘরগুলোর মধ্যে অদ্ভুত জমকালো সব চেহারার সৃষ্টি হতো। কিন্তু পশ্চিমের বা পেছনের দিককার কামরাটায় এই আগুনে আলোর ছটা রক্তলাল রঙের কাঁচের মধ্যে দিয়ে কুচকুচে কালো রঙের পর্দায় পড়ে চরম ভয়াবহ দেখাতো। যারা ওই ঘরে ঢুকতো তাদেরকে ওই পরিবেশে এমন আতঙ্কজনক দেখাতো যে, প্রিন্সের সঙ্গী-সাথীদের মধ্যে প্রায় কেউই ওই ঘরে পা রাখার সাহস করতো না।
[চলবে]
ভাষান্তর: জ্যোতির্ময়নন্দী