কৃষি ঋণ বনাম কৃষি প্রণোদনা এবং বাংলাদেশের কৃষি ও কৃষক

সরকার সাধারণ ছুটি ঘোষণার খুব অল্প সময়ের মধ্যে দর্জি মালিক বা গার্মেন্টস মালিকদের জন্য নামমাত্র সুদে (২%) ৫০০০ কোটি টাকা প্রণোদনা ঘোষণা করল। আর আমরা হৈ হৈ করে উঠলাম, গার্মেন্টস মালিকদের জন্য প্রণোদনা ঘোষণা করল, কৃষকদের জন্য কোন প্রণোদনা নাই কেন? সরকার বাহাদুর আমাদের মুখ বন্ধ করতে অমনি কৃষকদের জন্য ৫% সুদে ৫০০০ কোটি টাকা প্রণোদনা ঘোষণা করে দিল। আমরা তখন কেউ হিসাব করতে বসলাম, কৃষক মাথাপিছু কত টাকা ঋণ পাবেন? কেউ হিসাব করলাম, মাথাপিছু ২,৫০০ টাকা, কেউ ২৫,০০০ টাকা। কিন্তু আমরা কেউ প্রশ্ন তুললাম না, ২৫ তারিখ পর্যন্ত অর্থাৎ পুরো মাস কাজ করার পর গার্মেন্টস শ্রমিকদের বেতন মালিক না দিয়ে সরকার দেবে কেন? লক-ডাউন দিয়ে অন্যান্য সেক্টরেরে লাখ লাখ মানুষের জীবিকা যেখানে হঠাৎ বন্ধ করে দিল, সেখানে তড়িঘড়ি করে শুধুমাত্র দর্জি মালিকদের জন্য প্রণোদনা ঘোষণার কারণ আমাদের জানা।

কিন্তু আমরা যারা কৃষকের জন্য প্রণোদনা দাবি করলাম, প্রথমত, আমরা কি জানি, কৃষকের এই মুহূর্তে সবচেয়ে দরকার কি? প্রণোদনা বা ভূর্তকির টাকা কোন ধরণের কৃষক কোন কোন সেক্টরে কিভাবে পায়? কৃষক আসলে এখন কারা? কত শতাংশ জমির মালিক বর্তমানে সরাসরি চাষাবাদে জড়িত? আর কত শতাংশ বর্গা, চুক্তি/ইজারা ও নারীচাষী কত শতাংশ জমি চাষাবাদের সাথে যুক্ত? এই বর্গা-চুক্তি-নারীচাষীরা কি সরকারি হিসাবের খাতায় কৃষি ঋণ পাওয়ার যোগ্য কিনা? জ্ঞাতার্থে জানাচ্ছি, বর্গা ও ভূমিহীন কৃষক প্রায় ৮৯ লাখ । জমির মালিকানা এবং লিখিত চুক্তি না থাকায় বর্গা ও ইজারা চাষীরা কৃষি ঋণ থেকে বঞ্চিত। আর বাংলাদেশের ৯২ লাখ নারী কৃষিকাজে যুক্ত এবং কৃষিকাজের ৭২ শতাংশ নারীরা করলেও তারা কৃষক হিসাবে স্বীকৃত নন। সুতরাং কৃষি ঋণ/ভূর্তকি পাবার অধিকার তাদের নাই। তাহলে তাদের ঋণের উৎস কি? – এনজিও/দাদন ব্যবসায়ী, গ্রামীণ মহাজন।

দ্বিতীয়ত, কৃষির সাথে সম্পর্কহীন আমরা কি জানি, কৃষক এই সময় এই ঋণ দিয়ে কি করবে? কৃষকের মূল টাকা লাগে, বোরো ধান এবং সবজি আবাদের জন্য। এরপর আছে, আলু, গম, ভুট্টা ও আমন ধান। মালিক ও বর্গা/চুক্তির কৃষকের আমন ধান, শীতকালীন সবজি, আলু, গম উঠে গেছে। কাটার ও তোলার অপেক্ষায় ক্ষেতে আছে বোরো এবং ভুট্টা। বর্ষা/গ্রীষ্মকালীন সবজি লাগানোও মোটামুটি শেষ, যা নিয়ে কৃষক এখন বুক চাপড়াচ্ছেন। এনজিও/মহাজন থেকে হাজার হাজার টাকা ঋণ নিয়ে ধান আবাদ করে দাম পাননি, সবজি আবাদ করে এখন রাস্তার ধারে ঢেলে দিচ্ছেন, গরুকে খাওয়াচ্ছেন। অপরিকল্পিত লক-ডাউন দিয়ে তিন কোটি কৃষক ও তাদের পরিবারকে সর্বস্বান্ত করেছে সরকার। সামনে আছে শুধু আউশ মৌসুম। বর্তমানে বাংলাদেশে সবচেয়ে কম আবাদ হয় আউশ ধান, খরচও কম। সুতরাং এই মৌসুমে ঋণ নিয়ে তাঁরা কি করবেন?
এই মুহূর্তে সব ধরণের কৃষকের সামনে মূল চ্যালেঞ্জ বা সংকট হল, ধান কাটা/মাড়াইয়ের শ্রমিক সংকট, সরকারের কাছে সরাসরি ধান বিক্রয়, ধান, সবজি ভুট্টাসহ ফসলের ন্যায্য মূল্য এবং সরবরাহ চেইন স্বাভাবিক রাখা।

এসব মাথায় না রেখে যারা কেতাবি ভাষায় কৃষকের সংজ্ঞা মুখস্থ বলেন এবং ডাটা ম্যানিপুলেট করে কৃষক ও কৃষি অর্থনীতি হিসাব-নিকাশ দেন কৃষকের কাছে তাঁরা বিদ্যাপতি ভিনগ্রহের মানুষ, তাঁদের ভাষা কৃষকের কাছে অচেনা।

সুতরাং কৃষকের সংকট বুঝুন, সংকট সমাধানে সরকারকে বাধ্য করুন।

লেখক
সাদিয়া জেরিন পিয়া
সদস্য রাষ্ট্র চিন্তা

Sharing is caring!

Related Articles

Back to top button