
আইনে আটকে গেল নদীর খননকাজ
চুয়াডাঙ্গা জেলার ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া চারটি নদীর খননকাজ শুরু করেছে পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো)। খননকাজ চালু হওয়ার পর একাধিক ব্যক্তি ব্যক্তিমালিকানাধীন জমি দাবি করে একাধিক মামলা করেন আদালতে। এরই মধ্যে আদালত অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞা জারি করেছেন। এ অবস্থায় খননকাজে দেখা দিয়েছে অনিশ্চয়তা।
নদী খননের বিপক্ষে যাঁরা আদালতে মামলা দায়ের করেছেন তাঁদের দাবি, নদীর গতিপথ সঠিকভাবে নিরূপণ না করে চুয়াডাঙ্গা পানি উন্নয়ন বোর্ড খননকাজ শুরু করে। এ জন্য দেখা দিয়েছে জটিলতা। কোনো কাগজপত্রে নদী বলে উল্লেখ নেই, এমন জমিও খনন করছে পাউবো। পাউবোর উচিত ছিল, খননকাজ শুরুর আগে জটিলতা সমাধান করা; কিন্তু তা করেনি পাউবো। এ জন্য এই সংকট দেখা দিয়েছে।
চুয়াডাঙ্গা পাউবো সূত্র জানায়, চুয়াডাঙ্গা জেলায় চারটি নদী খননের কাজ শুরু হয়েছে। এর মধ্যে নবগঙ্গা ১৪ কিলোমিটার, চিত্রা ২২ কিলোমিটার, কুমার ২২ কিলোমিটার ও নৌকার খাল ছয় কিলোমিটার খনন করা হবে। গত বছরের ১৪ সেপ্টেম্বর চুয়াডাঙ্গা-১ আসনের সংসদ সদস্য সোলায়মান হক জোয়ার্দ্দার ছেলুন নবগঙ্গা খাল খননের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করে নদী খনন কার্যক্রম শুরু করেন। উদ্বোধনের পরপরই নবগঙ্গা, কুমার, চিত্রা ও নৌকার খালের খননকাজ শুরু হয়ে যায়। এরই মধ্যে ৩৫-৪০ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। খননকাজ শুরুর পর থেকে এর বিপক্ষে আদালতে ৩০-৩৫টি মামলা করা হয়েছে। এর মধ্যে বেশ কিছু মামলায় পাউবোকে শোকজ করা হয়েছে। কোনো কোনো মামলায় অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী, যেসব স্থানে অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে সেসব স্থানে খননকাজ বন্ধ রয়েছে।
স্থানীয়দের দাবি, সরকারি উদ্যোগ প্রশংসনীয়। খননকাজ শুরু হওয়া সব কয়টি নদীই বেশির ভাগ স্থানে পুরোপুরি ভরাট হয়ে গেছে অনেক আগে। ভরাট হয়ে যাওয়া স্থানে দীর্ঘদিন ধরে চলছে চাষাবাদ। কোথাও কোথাও বাড়িঘর নির্মিত হয়েছে। নদীর সঠিক সীমারেখা অনেক ক্ষেত্রে এখন খুঁজে বের করা কষ্টসাধ্য। পাউবো সিএস রেকর্ডে নদীর সীমারেখা ধরে খননকাজ শুরু করে; কিন্তু তাতেও পুরোপুরি সমাধান হয়নি।
অনেকে অভিযোগ করেন, পাউবো কখনই নদী ছিল না কিংবা নদী হিসেবে রেকর্ডপত্রেও উল্লেখ নেই এমন জমিতে খননকাজ করতে গিয়ে জটিতলার সৃষ্টি করেছে। ফলে খনন ঠেকাতে আদালতের শরণাপন্ন হতে হয়েছে অনেককে।
চুয়াডাঙ্গা জেলা জজ কোর্টের আইনজীবী আলমগীর হোসেন বলেন, ‘দামুড়হুদা উপজেলার দুধপাতিলা গ্রামে আমার জমিকে পাউবো নদী হিসেবে খনন শুরু করে। এ অবস্থায় আমি আদালতের শরণাপন্ন হতে বাধ্য হয়েছি।’
জীবননগরের উথলী গ্রামের জাহিদ হোসেন বলেন, ‘আমারসহ আরো অনেকের জমি খনন করার জন্য পাউবো চিহ্নিত করেছে। আমরা সবাই মামলার প্রস্তুতি নিয়েছি। পাউবো খননের জন্য উথলী গ্রামে যে স্থান নির্ধারণ করেছে, সেখানে কখনো নদী ছিল না।’
নাম প্রকাশ না করার শর্তে নদী খনন এলাকার কয়েকজন জানান, অনেক স্থানে ভূমিদস্যুদের জাল কাগজপত্রের ব্যাপার আছে। অনেক জমি কেনাবেচার মাধ্যমে হাতবদলও হয়েছে। এসব বিষয় সরকারিভাবে অনেক আগে দেখা উচিত ছিল। অনেক দেরি হয়ে গেছে। এসব কারণে জটিতলা বেড়েছে। একসময় চুয়াডাঙ্গার ওপর দিয়ে বয়ে চলা নদীতে জাহাজ চলেছে। প্রায় সব মানুষ চাইছে, মৃতপ্রায় নদী আবার বেঁচে উঠুক। নদীতে স্রোত বয়ে যাওয়া শুরু হোক। এ জন্য আইনি লড়াইয়ের পাশাপাশি জনপ্রতিনিধি, রাজনীতিবিদ, সুধীসমাজকে এগিয়ে এসে সমাধান করতে হবে।
সদর উপজেলার ফুলবাড়ী গ্রামের কয়েকজন জানান, দেশের স্বার্থে তাঁরা কিছুটা ছাড় দিয়েছেন। খননের সময় তাঁদের জমির কিছু কিছু অংশ চলে গেছে নদীতে, তাঁরা তা মেনে নিয়েছেন। যাঁরা একটুও ছাড় দিতে নারাজ, তাঁদের জন্য খননকাজ বিঘ্নিত হচ্ছে।
এসব ব্যাপারে পাউবোর উপসহকারী প্রকৌশলী মো. সালাহ উদ্দীন বলেন, ‘২৮টি মামলার কাগজপত্র আমাদের হাতে এসেছে। যেসব স্থানে আদালত থেকে অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে, সেসব স্থানে আমরা খননকাজ বন্ধ রেখেছি। যেসব স্থানে কারো কোনো আপত্তি নেই, সেগুলোতে খননকাজ চলছে। যেসব স্থানে নিষেধাজ্ঞা আছে, সেসব স্থানের ব্যাপারে আদালতের চূড়ান্ত নির্দেশনা অনুযায়ী পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া হবে। তবে আমরা সঠিকভাবে আমাদের কাজ শুরু করেছি। আমরা সঠিক অবস্থানেই আছি।’