
মরে যাচ্ছে বুড়িগঙ্গা
যে নদীর গুরুত্বের কারণে তার তীরে গড়ে ওঠে ঢাকা শহর। ৪০০ বছরের বেশি সময় ধরে যে নদী সারা দেশ ও বিদেশের সঙ্গে যোগাযোগ ঘটিয়ে গেছে ঢাকার, তার কিনার ধরে এখন ভেসে উঠেছে পথ রুদ্ধকারী চর। বুড়িগঙ্গার বুক চিরে এখন প্রতিদিন চলা শত শত লঞ্চ, পণ্যবাহী নৌযান, নৌকাসহ সব জলযান আর সংশ্লিষ্ট সব মানুষের জন্য এই চর বার্তা দিচ্ছে—দূষণ দখল অনেক করেছে, এবার বন্ধ হচ্ছে তোমাদেরও চলাচল।
অশনিসংকেত হয়ে দেখা দেওয়া এই চর আর কোথাও নয়, জেগেছে একেবারে ঢাকার লঞ্চ টার্মিনাল সদরঘাটের পাশে। চরের বিস্তৃতি আর কিছু বাড়লে সদরঘাট থেকে লঞ্চ চলাচল বন্ধ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা করছে অনেকে। বর্তমানে বড় বড় লঞ্চ চলছে বাড়তি সতর্কতা নিয়ে খুব সাবধানতার সঙ্গে। একটু এদিক-সেদিক হলেই দুর্ঘটনার ভয়। লঞ্চ চালকরা জানিয়েছেন, সদরঘাট থেকে একটি লঞ্চ ছাড়ার সময় বিপরীত দিক থেকে আসা লঞ্চকে দূর থেকেই গতি কমিয়ে সাইড দিতে হয়। ফলে সময় ব্যয় হচ্ছে।
গতকাল বৃহস্পতিবার সদরঘাট এলাকায় গিয়ে দেখা গেছে, শ্যামবাজারের পাশে বুড়িগঙ্গায় এই চর জেগেছে। সেখানে যে কেউ হেঁটে চলাচল করতে পারছে। অনেকটা এলাকাজুড়ে এই চর। চরের মাঝ দিয়ে আবার ময়লা-আবর্জনাসহ স্যুয়ারেজ লাইনের পানি নদীতে ঢুকছে। নদীর এক কিনার ধরে চর জেগে ওঠায় নদী এখন অনেকটা খালে পরিণত হয়েছে। যেটুকু পানি দৃশ্যমান সেটিকে স্যুয়ারেজ লাইনের পানি বলা যেতে পারে। নদী থেকে নাকে ঢোকে উৎকট গন্ধ। এতে আশপাশের এলাকার বাসিন্দা এবং নদীপথের যাত্রীরা স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে পড়ছে।
শ্যামবাজারের ব্যবসায়ীরা বলেন, বুড়িগঙ্গার ওপর ভর করে সদরঘাটে গড়ে ওঠা বিশাল লঞ্চ টার্মিনাল ও উল্টো পাশে কেরানীগঞ্জের দিকে শতাধিক লঞ্চ, বালু পরিবহন করা বলগেট নোঙর করে রাখা হয়। কোনো কোনোটি মেরামত করার জন্যেও অনেক দিন পড়ে থাকে। ফলে নদীর জায়গাও কমে গেছে।
সদরঘাট থেকে বরিশাল, পটুয়াখালী, ভোলা, চাঁদপুরসহ বিভিন্ন জেলায় লঞ্চ চলাচল করে। প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ এই নৌযান ব্যবহার করে গন্তব্য পৌঁছায়। একেকটি লঞ্চের অন্তত ১০ ফিট পানির নিচে থাকে। ফলে যেভাবে চর জেগে উঠছে তাতে করে যেকোনো সময় লঞ্চ চলাচল বন্ধ হয়ে যেতে পারে। এক ব্যবসায়ী জানান, জানুয়ারির শুরু থেকে নদীর পানি কমতে শুরু করে। জানুয়ারির শেষ দিকে এসে চর জেগে উঠেছে। অন্যান্য বছর পানি কমলেও এমনভাবে চর জাগতে দেখা যায়নি। আর পানি কমে যাওয়ায় পানি থেকে প্রচণ্ড গন্ধ ছড়াচ্ছে।
পুরান ঢাকার ফরাশগঞ্জের দিক থেকে কেরানীগঞ্জের দিকে নৌকায় চলাচল করার ঘাট রয়েছে। নদীতে চর পড়ে যাওয়ার কারণে প্রায় মাঝ নদী থেকে নৌকা চলাচল করে। নৌকার মাঝি আবদুল আজিজ বলেন, ‘এইডা এহন আর নদী নাই। খাল অইয়া গেছে। পানিতে খুবই গন্ধ। ঢাহা শহরের সব ময়লা পানি এই নদীতে আইসা পড়ে। যে অবস্থা হইতাছে তাতে কবে যে এই এলাকায় পুরাটাই চর উইটা যায় সেইটা আল্লাই জানেন।’ তিনি জানান, পানিতে যে চরটুকু দেখা যাচ্ছে তার কাছাকাছি কয়েক গজ পর্যন্ত পানি মাত্র ৮-১০ ফুট। ফলে কেরানীগঞ্জের দিক দিয়ে নদীর গভীরতা থাকায় বড় লঞ্চগুলো সে দিক দিয়ে চলছে।
শ্যামবাজারের তরকারি বিক্রেতা হেলাল উদ্দিন জানান, তাঁদের তরিতরকারির বেশির ভাগই আসে নৌকায় করে। নদীর পানি দিন দিন এত শুকাচ্ছে যে একসময় নৌকা চলাচলই হয়তো বন্ধ হয়ে যাবে।
‘এমভি কীর্তন খোলা-১০’ নামের লঞ্চের মাস্টার (চালক) নূরুল ইসলাম জানান, তিনি ৩০ বছর ধরে লঞ্চ চালান। কিন্তু এবারের মতো এমন চর পড়তে দেখেননি কখনো। নূরুল বলেন, ‘চর খনন করা না হলে এবং যদি আরো চর জাগে তাহলে জাহাজ চলাচল করা যাবে কি না সন্দেহ।’ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘ঢাকার দিকে নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লার বক্তাবলী এলাকায় আসার পরই বুড়িগঙ্গায় সতর্কতার সঙ্গে লঞ্চ চালাতে হয়। পোস্তগোলা ব্রিজ পার হওয়ার পর লক্ষ রাখতে হয় সদরঘাট থেকে কোনো লঞ্চ ছেড়ে আসছে কি না। কারণ চর পড়ায় বড় দুটি লঞ্চ পাশাপাশি পার হওয়া ঝুঁকিপূর্ণ। ফলে পোস্তগোলা ব্রিজের নিচ থেকে গতি কমিয়ে ওই লঞ্চকে জায়গা দেওয়া হয়। সদরঘাট থেকে ছাড়তে যাওয়া লঞ্চ যদি দেখে যে বড় লঞ্চ আসছে তা হলে সেটা তখন আর না ছেড়ে অপেক্ষা করে। এভাবে সময় ব্যয় হচ্ছে বেশি। যেটা দুই বছর আগেও ছিল না।’
আরেক লঞ্চচালক জানান, বুড়িগঙ্গা নদীটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। রাজধানীর সঙ্গে যোগাযোগের কারণে সব ধরনের নৌযান চলাচল করে এ নদীতে। বিশেষ করে বালিবহনকারী বলগেটের কারণে লঞ্চ চলাচলে বেশ সমস্যা হয়। বালিভর্তি অবস্থায় বলগেটের কিছু অংশ পানির ওপর ভেসে থাকে। নদীর প্রশস্ততা কম থাকায় যেকোনো সময় লঞ্চের সঙ্গে ধাক্কা লেগে যেতে পারে। এ ছাড়া বলগেটগুলো নিয়মকানুন ছাড়াই চালানো হয়। এলোপাতাড়ি নোঙর করা হয়। ফলে সংঘর্ষের আশঙ্কা থাকে।
সমাধানের উপায় কী জানতে চাইলে চালকরা জানান, ফরাশগঞ্জে ব্রিজের নিচ দিয়ে স্যুয়ারেজ লাইনের যে পানি আসে তা বন্ধ করতে হবে। যদি না পারা যায় তা হলে যাতে ময়লা-আবর্জনা না এসে শুধু পানি আসে সে ব্যবস্থা করা উচিত। আর সদরঘাটকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য দ্রুত জেগে ওঠা চর খনন করার বিকল্প নেই।
পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের (পবা) চেয়ারম্যান আবু নাসের খান বলেন, ‘বুড়িগঙ্গায় চর জাগা ভয়ংকর একটি বিষয়। দিন দিন এই নদীর পানিপ্রবাহ কমছে। বুড়িগঙ্গায় শিল্প বর্জ্য, নৌ বর্জ্য ও গার্মেন্ট বর্জ্য, পলিথিন ফেলা হচ্ছে। এ ছাড়া সিটি করপোরেশনের ময়লা-আবর্জনাও যাচ্ছে নদীটিতে। আর এসব বর্জ্যর কারণেই চর পড়ছে। এ ছাড়া নৌযানে করে বালি নেওয়ার সময় বালি পড়েও ভরাট হচ্ছে।’
তিনি বলেন, দেশের নদ-নদী দখল, দূষণ ও ভরাটের কারণে মারাত্মক অবস্থা দেখা যাচ্ছে। বর্তমানে দখলদার উচ্ছেদের চেষ্টা হচ্ছে। দেশে দিন দিন নৌযান বাড়ছে, অন্যদিকে নদী কমছে। ফলে বুড়িগঙ্গার মতো ব্যস্ত একটি নদীতে নৌজট দেখা দেবে। উজানের পানি আসা কমে যাওয়ায় নদীতে পানিপ্রবাহ কমে যাচ্ছে। বুড়িগঙ্গাকে বাঁচাতে হলে সব ধরনের বর্জ্য ফেলা বন্ধ করতে হবে, নদীতীরের কাছাকাছি জায়গায় খনন করতে হবে।’ প্রশ্নের জবাবে তিনি জানান, ২০০৭ সালের দিকে বুড়িগঙ্গা খনন করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু খননের পর সেই বর্জ্য কোথায় ফেলা হবে সেই সিদ্ধান্ত নিতে না পারার কারণে কিছু খননের পর তা বন্ধ করে দেওয়া হয়।
নদী রক্ষা কমিশনের সদস্য মোহাম্মদ আলাউদ্দিন এ বিষয়ে বলেন, ‘বিষয়টি আমাদের নজরে আসেনি। আমরা খোঁজ নিয়ে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য সংশ্লিষ্টদের অবশ্যই বলব।’
নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মো. আবদুস সামাদ গত রাতে বলেন, ‘যেখানেই নদীতীরের জায়গা ও নদী ভরে গেছে, সেখানে খনন করে নদী প্রশস্ত করছি। পর্যায়ক্রমে খনন করা হবে।’ শ্যামবাজারের পাশে জাগা চর প্রসঙ্গে প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমরা জানি, আমাদের সার্ভে করা আছে। যেখানে চর জেগেছে সেখানে পর্যায়ক্রমে খনন করা হবে।’
জানতে চাইলে বিআইডাব্লিউটিএর যুগ্ম পরিচালক এ কে এম আরিফ উদ্দিন বলেন, ‘এখন শুষ্ক মৌসুম। এ সময় পানি কমে যায়। ফলে নাব্যতা কমে যায়। আমরা জেগে ওঠা চরটি দেখেছি। সেটি খননের জন্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে।’
বুড়িগঙ্গার তীরে ঢাকাকে দেখাত ভেনিসের মতো : একসময় সমৃদ্ধিশালী ঢাকায় ইংরেজদের জাহাজ আসত খালি আর পণ্যবোঝাই করে নিয়ে যেত লন্ডনে। ঢাকার মসলিনের খ্যাতি পারস্য, আফ্রিকা, ইউরোপে ছড়িয়ে পড়েছিল। বুড়িগঙ্গার পারে গড়ে ওঠে ঢাকা শহর। উইকিপিডিয়ার তথ্যানুসারে, ব্রহ্মপুত্র আর শীতলক্ষ্যার পানি এক স্রোতে মিশে বুড়িগঙ্গা নদীর সৃষ্টি হয়েছিল। তবে বর্তমানে এটা ধলেশ্বরীর শাখাবিশেষ। কথিত আছে, গঙ্গা নদীর একটি ধারা প্রাচীনকালে ধলেশ্বরী হয়ে সোজা দক্ষিণে বঙ্গোপসাগরে মিশেছিল। পরে গঙ্গার সেই ধারাটির গতিপথ পরিবর্তন হলে গঙ্গার সঙ্গে তার সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। তবে প্রাচীন গঙ্গা এই পথে প্রবাহিত হতো বলেই নদীটির এমন নামকরণ। মূলত ধলেশ্বরী থেকে বুড়িগঙ্গার উৎপত্তি। কলাতিয়া এর উৎপত্তিস্থল। বর্তমানে উৎসমুখটি ভরাট হওয়ায় পুরনো কোনো চিহ্ন খুঁজে পাওয়া যায় না।
বাংলার সুবাদার মুকাররম খাঁর শাসনামলে শহরের যে অংশ নদীর তীরে অবস্থিত ছিল, সেখানে প্রতি রাতে আলোকসজ্জা করা হতো। নদীর বুকে অসংখ্য নৌকাতে জ্বলত ফানুস বাতি। তখন বুড়িগঙ্গার তীরে অপরূপ সৌন্দর্যের সৃষ্টি হতো। ১৮০০ সালে ইউরোপের বণিক টেইলর বুড়িগঙ্গা নদী দেখে মুগ্ধ হয়ে লিখেছিলেন—‘বর্ষাকালে যখন বুড়িগঙ্গা পানিতে ভরপুর থাকে তখন দূর থেকে ঢাকাকে দেখায় ভেনিসের মতো।’
বুড়িগঙ্গা সাকুল্যে ৩০ কিলোমিটার দীর্ঘ। গড়পড়তা ৪০০ মিটার প্রশস্ত। গভীরতা প্রায় ৪০ মিটার। ১৯৮৪ সালে এর পানিপ্রবাহের পরিমাণ ছিল সর্বোচ্চ দুই হাজার ৯০২ কিউসেক। বর্তমানে পানিপ্রবাহের পরিমাণ প্রায় অর্ধেকে নেমে এসেছে।