
সংকটে বিবর্ণ ঐতিহ্যের বিদ্যাপীঠ -ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
বিতর্কিত ও পক্ষপাতদুষ্ট শিক্ষক নিয়োগ। যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন থাকার পরও একের পর এক নতুন বিভাগ চালু। সেই সঙ্গে নানা নামে সান্ধ্য কোর্স খুলে তৈরি করা হচ্ছে নিম্নমানের সনদধারী। প্রতিষ্ঠার শতবর্ষের দ্বারপ্রান্তে এসেও ভুগতে হচ্ছে শ্রেণীকক্ষ সংকটে। দৃশ্যমান আবাসন সংকটও। সর্বোপরি সুশাসনের ঘাটতিতে ঐতিহ্যের রঙ হারাচ্ছে দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
যদিও প্রতিষ্ঠাকাল থেকে শিক্ষার উচ্চমান বজায় রাখতে সচেষ্ট ছিল বিশ্ববিদ্যালয়টি। আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে এর স্বীকৃতিও মেলে। খ্যাতি লাভ করে প্রাচ্যের অক্সফোর্ড হিসেবে।
শিক্ষার গুণগত মানের অনেকটাই নির্ভর করে শিক্ষকের ওপর। শিক্ষক নিয়োগে যোগ্যতাকে পাশ কাটিয়ে পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ রয়েছে দেশের সবচেয়ে পুরনো এ উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে। বিজ্ঞপ্তি ছাড়াই শিক্ষক নিয়োগের ঘটনা ঘটেছে। বিজ্ঞপ্তিতে উল্লিখিত পদের অতিরিক্ত শিক্ষক নিয়োগের নজির তৈরি করেছে বিশ্ববিদ্যালয়টি। বিজ্ঞপ্তিতে জুড়ে দেয়া শর্ত পূরণ না করার মতো অনিয়মও হয়েছে।
সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক সাদেকা হালিম বলেন, গত কয়েক বছরে শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে যোগ্যতাকে গুরুত্ব না দিয়ে অনুগত তথা ‘ভোটার’ নিয়োগ দেয়া হয়েছে। একজন অযোগ্য লোককে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেয়ার ফলে আগামী কয়েক দশক শিক্ষার্থীরা গুণগত পাঠদান থেকে যে বঞ্চিত হবেন, একবারের জন্যও সেটা ভাবা হয়নি।
পথচলার ৯৬ বছরেও অবকাঠামো সংকট প্রকট বিশ্ববিদ্যালয়টিতে। বিশেষ করে শ্রেণীকক্ষ সংকট প্রকট আকার ধারণ করেছে কলা অনুষদের বিভাগগুলোয়। বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠাকাল থেকে দর্শন বিভাগের শ্রেণীকক্ষ এখনো একটি। শ্রেণীকক্ষ সংকটে বিভাগের সেমিনার কক্ষকে (কলা ভবনের ২০২৮ নং) ব্যবহার করা হচ্ছে শ্রেণীকক্ষ হিসেবে। ১২০ জনের ধারণ ক্ষমতাসম্পন্ন এ শ্রেণীকক্ষে দুই শতাধিক শিক্ষার্থীর ক্লাস করা সম্ভব হয় না। ক্লাসের বাইরেও দাঁড়িয়ে থাকেন অনেকে।
একই সংকট ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগেও। দুটি শ্রেণীকক্ষ নিয়ে এ বিভাগের কার্যক্রম পরিচালিত হলেও অনেক সময়ই ক্লাস নেয়ার জন্য শ্রেণীকক্ষ নির্দিষ্ট থাকে না বলে অভিযোগ শিক্ষার্থীদের। বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী শেখ আহমেদ নুরুল্লাহ জামী বলেন, ক্লাস রুটিনেও স্থান নির্দিষ্ট না থাকায় ক্লাস করার জন্য প্রায় সময়ই ঘুরতে হয় কলা ভবনের এদিক-ওদিক। কখনো লোকপ্রশাসন, ইসলামিক স্টাডিজ, ইংরেজি বিভাগের ক্লাসরুমে দৌড়াতে হয়।
শিক্ষার্থীদের জন্য শতভাগ আবাসন সুবিধা নিয়ে যাত্রা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের। কিন্তু সময়ের আবর্তে শিক্ষার্থী বাড়লেও আনুপাতিক হারে বাড়ানো হয়নি আবাসন সুবিধা। ফলে সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠে পড়তে এসে তীব্র আবাসন সংকটে ভুগতে হয় শিক্ষার্থীদের।
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ভবন সূত্রে জানা যায়, ২০১৬ সালের জুন পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের ১২টি ইনস্টিটিউট ও ১০টি অনুষদের নিয়মিত শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৩৭ হাজারেরও বেশি। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৯টি আবাসিক হল ও চারটি হোস্টেল মিলে মোট ১৩ হাজার ১২৭ জন ছাত্রছাত্রীর থাকার ব্যবস্থা রয়েছে। অর্থাত্ ৬৫ শতাংশ শিক্ষার্থীর জন্য কোনো আবাসন ব্যবস্থা নেই।
গবেষণায় একসময় জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সুনাম কুড়িয়েছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা। সে ঐতিহ্যও হারিয়েছে এ বিদ্যাপীঠ। বিশ্ববিদ্যালয়ের বার্ষিক বিবরণী (২০১৪-১৫) অনুযায়ী, ওই শিক্ষাবর্ষে ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদের প্রায় ৯১ শতাংশ শিক্ষকের কোনো ধরনের গবেষণা, প্রবন্ধ বা প্রকাশনা ছিল না। একইভাবে কোনো ধরনের গবেষণাকাজে ছিলেন না আইন অনুষদের ৯৫, কলা অনুষদের ৭৫ ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ৯০ শতাংশ শিক্ষক।
বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়টিতে গবেষণাকেন্দ্র রয়েছে ৪৫টির মতো। এর মধ্যে কিছু কেন্দ্রে প্রতিষ্ঠার পর থেকে কখনই কোনো মৌলিক গবেষণা হয়নি। অথচ গবেষণাকাজে প্রতি বছর একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ বরাদ্দ থাকে। এর বেশির ভাগই খরচ হয় সভা-সেমিনারে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মোট বিভাগ রয়েছে ৮৩টি। এর মধ্যে গত আট বছরে ১৮টি বিভাগ ও দুটি ইনস্টিটিউট চালু হয়েছে। এর মধ্যে বেশ কয়েকটি নতুন বিভাগের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে প্রশ্ন থাকলেও একের পর এক এ সংখ্যা বাড়ছে।
অভিযোগ রয়েছে, নতুন বিভাগ বা কোর্স খোলার ব্যাপারে এড়িয়ে যাওয়া হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের (ইউজিসি) অনুমোদনের বিষয়টিও। প্রাথমিক অনুমোদন পাওয়ার পর কোনো বিভাগের অবকাঠামোগত সুবিধা দেয়া তথা শ্রেণীকক্ষ, শিক্ষকদের বসার জায়গা, বিভাগের কার্যালয়, পাঠাগার ও গবেষণাগার স্থাপনের প্রক্রিয়া শুরু হয়। এক্ষেত্রে শুরুতেই অর্থ সংকটের মুখে পড়তে হয় বিভাগগুলোকে।
গত দুই দশকে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর সংখ্যা বেড়ে প্রায় দ্বিগুণ হলেও গ্রন্থাগার সেবার মান উন্নত হয়নি। শিক্ষার্থীদের দাবি সত্ত্বেও গেল তিন দশকে বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগার সম্প্রসারণের উদ্যোগ গ্রহণ করেনি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারে মোট আসন রয়েছে ১ হাজার ১০০টি। এর মধ্যে বিজ্ঞান গ্রন্থাগারে আসন রয়েছে ৪০০টি। সে হিসাবে গ্রন্থাগার সুবিধা রয়েছে মাত্র ৪ শতাংশ শিক্ষার্থীর জন্য। তীব্র আসন সংকটের ফলে গ্রন্থাগার খোলার ২ ঘণ্টা আগে ভোরবেলা এসে শিক্ষার্থীদের লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য (সাময়িক দায়িত্বপ্রাপ্ত) অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামান বণিক বার্তাকে বলেন, শিক্ষা ও প্রশাসনিক কার্যক্রম পরিচালনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন কমিটি, পর্ষদ কিংবা বডি রয়েছে। রয়েছে সুনির্দিষ্ট বিধানও। কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো ঐতিহ্যবাহী বিদ্যাপীঠে যদি নিয়মের ব্যত্যয় ঘটে, সেটি গোটা জাতির জন্যই হতাশার। অতীতে যদি এ ধরনের কোনো অনিয়ম ঘটে থাকে, আমাদের সেটি থেকে শিক্ষা নিতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বস্তরে সুশাসন নিশ্চিতই হবে আমাদের লক্ষ্য।
দুই যুগেরও বেশি সময় ধরে হচ্ছে না ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচন। রাষ্ট্রপতি ও বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য, উপাচার্য, শিক্ষক-শিক্ষার্থী, এমনকি ক্যাম্পাসে সক্রিয় ছাত্র সংগঠনগুলোসহ সবাই চায়, তার পরও ২৭ বছর ধরে ডাকসু নির্বাচন হচ্ছে না। গত ২৯ জুলাই ছাত্র প্রতিনিধি ছাড়া উপাচার্য প্যানেল নির্বাচনের প্রতিবাদ কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের হাতাহাতির ঘটনায় ডাকসু নির্বাচন দাবির আন্দোলন নতুন মাত্রা পেয়েছে। এর পর থেকে ধারাবাহিকভাবে আন্দোলন-কর্মসূচি পালন করছেন শিক্ষার্থীরা।
ডাকসু নির্বাচন না হলেও অসুস্থ শিক্ষক রাজনীতি চলছে জোরেশোরে। উচ্চপদস্থদের ক্ষমতা আঁকড়ে থাকার প্রবণতাও প্রকট। এসব কারণে ক্যাম্পাসে শিক্ষার স্বাভাবিক পরিবেশ নিশ্চিত করা সম্ভব হচ্ছে না বলে মনে করেন শিক্ষাবিদরা। ফলে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিতেও পিছিয়ে পড়ছে বিশ্ববিদ্যালয়টি। ঢুকতে পারছে না বিশ্বের প্রথম সারির ১০০, এমনকি ২০০ বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকায়ও।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় হলো জ্ঞান সৃষ্টি, বিতরণ ও অনুশীলনের জায়গা। এটি জ্ঞান আদান-প্রদানের একটি সামাজিক প্রতিষ্ঠানও বটে। একসময় বিশ্ববিদ্যালয়ের শ্রেণীকক্ষের বাইরে বিভিন্ন ধরনের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের মননশীলতা বিকশিত হতো। এখন সেটি নেই। আমাদের সময় লাইব্রেরিতে গিয়ে দেশী-বিদেশী গ্রন্থ অধ্যয়ন করতাম। এখনকার শিক্ষার্থীরা বিসিএস পড়েই বিশ্ববিদ্যালয়জীবন পার করে দেন। একসময় এখানে জ্ঞানের চর্চা ছিল। কিন্তু এখন তা অনুপস্থিত। কেননা শিক্ষকদের পদায়নে গবেষণা ও প্রকাশনার দরকার হয় না। শিক্ষার্থীদের জন্য কোনো স্বস্তিকর আবাসিক জীবন নেই। ঐতিহ্য হারিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এখন শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের রাজনৈতিক কলহ, ছিনতাই, চাঁদাবাজির আখড়ায় পরিণত হয়েছে। সাংস্কৃতিক অর্থে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এখন শিক্ষিত লোকদের বস্তিতে পরিণত হয়েছে।
লেখাঃ সাইফ সুজন