কস্তুরা প্রাচীরের মাধ্যমে উপকুলীয় অঞ্চলকে সুরক্ষা করার প্রক্রিয়া

প্রাকৃতিক সংকট সমাধানে প্রকৃতির স্বাভাবিক প্রক্রিয়াকে কাজে লাগানোর এক ধরনের পদ্ধতিকে বিজ্ঞানের ভাষায় বলে ইকো-ইঞ্জিনিয়ারিং বা পরিবেশ-প্রকৌশল। এই প্রাকৃতিক ঘটনাটিকে এবার কাজে লাগানোর পদ্ধতি বের করেছেন একদল গবেষক। দেশের দক্ষিণাঞ্চলে উপকূল রক্ষা বাঁধগুলোর ভাঙনরোধে কাজে লাগানো হবে ঝিনুককে, স্থানীয়ভাবে যা ‘কস্তুরা’ নামে বেশি পরিচিত। বাংলাদেশেরই একদল বিজ্ঞানী এ ক্ষেত্রে আশার আলো দেখাচ্ছেন। তাঁরা বলছেন, জোয়ার, জলোচ্ছ্বাসে উপকূলের বেড়িবাঁধের ভাঙন ঠেকাতে সমুদ্রেরই সম্পদ ঝিনুককে কাজে লাগিয়ে উপকূলে প্রাকৃতিক বেষ্টনী তৈরি করা সম্ভব। ইতিমধ্যে কক্সবাজারের কুতুবদিয়ায় পরীক্ষামূলকভাবে ‘কস্তুরা প্রাচীর’ তৈরি করে মূল বেড়িবাঁধের ভাঙন অনেক কমিয়ে আনা গেছে।

আগামী দশকে বিশ্বের গড় তাপমাত্রা আরো দুই ডিগ্রি সেলসিয়াস বাড়বে এবং এতে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতাও বৃদ্ধি পাবে। নদ-নদীতে বেড়ে যাবে লোনা পানির পরিমাণ। বিলুপ্তির মুখোমুখি হবে ২০ থেকে ৩০ শতাংশ প্রজাতির প্রাণী। বাস্তুভিটা হারাবে সমুদ্র তীরবর্তী এলাকার হাজার হাজার পরিবার। এসব এলাকায় তীব্র সঙ্কট দেখা দিতে পারে বিশুদ্ধ পানির। আবহাওয়া পরিবর্তনের ফলে পৃথিবীর যে সব দেশ ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে তার মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান দ্বিতীয়।
কক্সবাজারের উপকূলীয় এলাকার বিরাট একটি অংশ এ ক্ষতির সম্মুখীন হতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। এ আশঙ্কার মধ্যে রয়েছে দক্ষিণ চট্টগ্রামের বাঁশখালীর হাটখালী, ছনুয়া, কক্সবাজারের চকরিয়ার মগনামা, উজানটিয়া ও বাতিঘর খ্যাত দ্বীপ কুতুবদিয়া। ইতোমধ্যে কুতুবদিয়াসহ উপকূলবাসীর ঘাড়ে চেপে বসেছে আবহাওয়াগত পরিবর্তনের মারাত্মক প্রভাব।

গবেষণায় দেখা গেছে, কস্তুরা প্রাচীর শুধু ঢেউয়ের আঘাতই ঠেকায় না, বাড়তি কিছু উপকারও এ থেকে পাওয়া যায়। এ প্রাচীর ৩৪ প্রজাতির মাছ, ১১ প্রজাতির কাঁকড়া, ১৬ প্রজাতির চিংড়ি, ৩৫ প্রজাতির শামুক বা খোলস জাতীয় প্রাণীর উপযুক্ত আবাসস্থল তৈরিতে সহায়ক ভূমিকা রাখছে। রিংয়েরপ্রতি বর্গমিটার অংশ থেকে বছরে পাঁচ কেজি করে কস্তুরা জমবে। আবার প্রতি বর্গমিটার কস্তুরা প্রাচীর থেকে ২৩ কেজি মাছ, ১৬ কেজি চিংড়ি ও ১৭ কেজি কাঁকড়া পাওয়া যেতে পারে।

গবেষকেরা যেভাবে পরীক্ষাটি চালিয়েছেন, সেটা খুব সহজ। উপকূলীয় মূল বাঁধ থেকে কিছুটা দূরে সাগরের বালুতে কংক্রিটের গোলাকৃতির ‘রিং’ স্থাপন করা হবে। সাগরের পানিতে ভেসে আসা কস্তুরা এই রিংয়ের গায়ে জমে জমে প্রাচীরের আকার ধারণ করে। এটিই ‘কস্তুরা প্রাচীর’। প্রতি বর্গমিটারে এক হাজারের বেশি কস্তুরা জমে। ১২ মাসই কস্তুরার প্রজনন মৌসুম। ফলে কস্তুরা জমা হওয়ার হার নিয়ে চিন্তার কোনো কারণ নেই। গবেষক দল জানাচ্ছে, বাংলাদেশে এই প্রযুক্তি নতুন হলেও নেদারল্যান্ডস, যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া এ প্রযুক্তি ব্যবহার করে সাফল্য পেয়েছে। গবেষকদের মতে, কস্তুরা এমন এক সামুদ্রিক জীব, যারা নিজেদের বাসস্থানকে পারিপার্শ্বিক পরিবেশের সঙ্গে রূপান্তর ও বিকাশ ঘটিয়ে অন্যান্য জীবের বসবাসের অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করে।

কস্তুরা প্রাচীর সাগরের ঢেউ প্রশমন করবে। এতে উপকূলীয় এলাকা ভাঙনের হাত থেকে রক্ষা পাবে এবং প্রধান সুরক্ষা বাঁধের স্থায়িত্ব বৃদ্ধি পাবে। কংক্রিটের রিংয়ে কস্তুরা জমতে জমতে তা স্থায়ী কস্তুরা বাঁধে রূপান্তরিত হবে। কস্তুরা প্রাচীর পলিপ্রবাহ নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে ভূমিক্ষয় রোধ করবে এবং একে ঘিরে প্যারাবন সৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা আছে। এক কিলোমিটার দীর্ঘ এক স্তরের কস্তুরা প্রাচীর তৈরি করতে ১ হাজার কংক্রিটের রিং প্রয়োজন। প্রতিটি রিং তৈরিতে খরচ পড়বে ৫ হাজার টাকা। অর্থাৎ এক কিলোমিটার এলাকায় এক স্তরের কস্তুরা প্রাচীর তৈরিতে খরচ পড়বে ৫০ লাখ টাকা। তিন স্তরের হলে এতে ব্যয় হবে দেড় কোটি টাকা। মূল বাঁধের সামনে যদি কস্তুরার প্রাচীর স্থাপন করা হয়, তখন পাঁচ বছরে মূল বাঁধ একবার সংস্কার করলেই হবে

Sharing is caring!

Related Articles

Back to top button