
বেঁচে থাক আরজ আলী মাতুব্বরের পাঠাগার
কয়েকদিন আগে ঘুরে এলাম আরজ আলী মাতুব্বরের পাঠাগার থেকে। সেই কবে তার লেখাগুলো থেকে তার প্রতি অনুরাগ তৈরি হলো , ইচ্ছে জেগেছিল এই মানুষটার দাঁত-নখ আর চুলের কবরটা দেখার। তার তিলে তিলে গড়া পাঠাগার দেখার। এইবার বরিশাল ট্যুরের বদৌলতে এটা দেখার সেই সৌভাগ্য হয়ে গেল।
বরিশালের লামচরি গ্রামটা সেখানকার শহরে বাস করা অনেক মানুষই তেমন চেনেন না দেখলাম, আরজ আলী মাতুব্বরের সম্পর্কেও তেমন জানেন না। তবে জানলেও এখনো এই শতাব্দীতে এসেও আমাদের মানসিকতা যেহেতু সংস্কারমানা তাই তার প্রতি আগ্রহ কম তাদের। প্রথাবিরোধী ধর্মদর্শনের প্রাচীন ধারাবাহিকতার বাংলাদেশী রূপকার হলেন আরজ আলি মাতুব্বর। তিনি মনে করতেন পশু যেমন সামান্য জ্ঞান নিয়েই সন্তুষ্ট থাকে ধর্মবাদী ব্যক্তিগণও তেমনি সামান্য জ্ঞান নিয়েই জীবন কাটিয়ে দেয়। আরজ আলী মাতুব্বর (১৯০০–১৯৮৫), স্ব-শিক্ষিত, স্বধর্মত্যাগী দার্শনিক, চিন্তাবিদ এবং লেখক। তাঁর প্রকৃত নাম ছিলো “আরজ আলী”। আঞ্চলিক ভূস্বামী হওয়ার সুবাধে তিনি “মাতুব্বর” নাম ধারণ করেন। তিনি গরীব কৃষক পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেন। তিনি নিজ চেষ্টায় বিজ্ঞান ও দর্শনসহ বিভিন্ন বিষয়ের উপর জ্ঞান অর্জন করেন। জগত ও জীবন সম্পর্কে নানামুখী জিজ্ঞাসা তাঁর লেখায় উঠে এসেছে যা থেকে তাঁর প্রজ্ঞা, মুক্তচিন্তা ও মুক্তবুদ্ধির পরিচয় পাওয়া যায়। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার ঘাটতি সত্ত্বেও তিনি কতিপয় বই সাহসীকতার সহিত লেখেন। বিশ্ব ও জীবন সম্পর্কে তাঁর দার্শনিক লেখা বিতর্কিত হয়ে পড়ে।তাঁর বইগুলো সর্বদাই সরকার কর্তৃক নিষিদ্ধের হুমকিতে থাকত। মাতুব্বরকে তাঁর বই “সত্যের সন্ধানে”র জন্য বন্দী করা হয় এবং হাজতে নেয়া হয়।
আমরা লামচরি গেলাম গাড়ি নিয়ে, কিন্তু যাতায়াতের রাস্তাঘাটের অবস্থা ভয়াবহ। প্রাইভেট কার নিয়ে যাওয়া সেখানে বোকামি। যাওয়া যেতে পারে হলুদ অটো নিয়ে। খানাখন্দ, ভাঙ্গা-এবড়োথেবড়ো রাস্তা পেরিয়ে , কিছুদূর মটরসাইকেলে অবশেষে আমরা কাঙ্খিত পাঠাগারে পৌঁছালাম, অবশেষে খুঁজে বের করলাম আরজ আলী মাতুব্বরের সেই আরাধ্য পাঠাগার। কিন্তু দূর্ভাগ্য হলো সেখানে গিয়ে তালাবদ্ধ পাঠাগার দেখলাম। ভীষণ ব্যথিতচিত্তে দেখলাম দেয়ালে তার নাতী শামীম আলী মাতুব্বরের নম্বর দেয়া আছে। যোগাযোগের জন্য তাতে ফোন দিয়ে জানলাম উনি শহরে আছেন, আসতে ৩০ মিনিট সময় লাগবে। আমাদের হাতে সময় কম থাকায় আমাদের আর পাঠাগারের ভেতরটা দেখা হলো না, জানালা খোলা থাকায় কিছুটা দেখা হলো, তিনটি তাকে খুবই অযত্নে রাখা কীটদৃষ্ট কিছু বইয়ের ধূলিধূসর অস্তিত্ব। আর বাইরে বাউন্ডারীর ভেতর দুটা কবর দেখলাম, কিছু সুন্দর প্রানবন্ত গাছ দেখলাম। তবে আশেপাশে পরিস্কার ঝকঝকে।
পরে শহরে এসে তার নাতীর সাথে দেখা করলাম , তখন সে বুললো, একতলা ছোট্ট সেই পাঠাগার ভবনে কক্ষের সংখ্যা তিনটি। প্রথমটি পাঠকক্ষ। পাঠকক্ষসংলগ্ন অন্য কক্ষ দুটির একটিতে রয়েছে আরজ আলী মাতুব্বরের ব্যবহূত কিছু জিনিসপত্র। ঠিক তার পাশের কক্ষটির ভেতরেই রয়েছে আরজ আলী মাতুব্বরের সংগৃহীত বইপত্র।
কিন্তু এমন হীন দশা কেন আরজের স্বপ্নবিজড়িত এই প্রতিষ্ঠানটির? কেন সাপ্তাহিক খোলা একটি দিনে সেখানে কেউ নেই, কোন পাঠক এলে সেতো বই নিতে পারবে না। দেয়ার জন্য সেখানে কাউকে দেখা গেল না, তবে কি আরজের অন্তর্দীপ্ত আহ্বানে বিন্দুমাত্র আন্দোলিত হয়নি লামচরি গ্রামের মানুষ বা তার আপন কারো? কুসংস্কারের বিরুদ্ধে, ধর্মীয় গোঁড়ামির বিরুদ্ধে শুরু করা আরজের আকাঙ্ক্ষিত যুদ্ধের অপমৃত্যুর আশঙ্কায় বিচলিত হই আমরা। যত্নের অভাবে কি একঅসময় এই পাঠাগার বন্ধ হয়ে যাবে?